topরাজনীতি

বিশ্বে বাড়ছে দুর্ভিক্ষজনিত মৃত্যু

টাইমস ২৪ ডটনেট: গত কয়েক শতকে দুর্ভিক্ষের কারণে কোটি কোটি মৃত্যু দেখেছে বিশ্বে। দুই থেকে আড়াই দশক আগেও এ হার কমে আসছিল। কিন্তু এখন প্রতিদিন সুদান থেকে আফগানিস্তান, ইয়েমেন বা গাজাসহ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে খাদ্যের অভাবে মৃত্যুর মিছিলে শামিল হচ্ছে হাজার হাজার মানুষ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জনমতের উদাসিনতা ও মানবিক সংস্থাগুলোর সামর্থ্য কমে যাওয়ায় নেতারা খাদ্যকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে সক্ষম হচ্ছেন। দুর্ভিক্ষ বিশেষজ্ঞ ও যুক্তরাষ্ট্রের তাফটস বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্লেচার স্কুল অব ল অ্যান্ড ডিপ্লোম্যাসি পরিচালিত ওয়ার্ল্ড পিস ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক আলেক্স ডি ওয়াল বলেন, ‘প্রায় ১০ বছর আগে দুর্ভিক্ষ ফিরে আসতে শুরু করে। গত কয়েক বছরে ক্ষুধায় মৃতের সংখ্যা ভয়াবহভাবে বাড়তে দেখছি আমরা।’
বিশেষজ্ঞদের মতে, দুর্ভিক্ষ ফিরে আসার আংশিক কারণ এর প্রতি দুর্বল মানবিক প্রতিক্রিয়া। বহু-পক্ষীয় পদক্ষেপের প্রতি কম উদ্দীপনা ও সাহায্য তহবিল হ্রাসের কারণে দুর্যোগের আক্রান্ত অঞ্চলে বাড়ছে খাদ্যাভাব।সম্প্রতি দুর্ভিক্ষজনিত মৃত্যুর হিসাব রাখার ক্ষেত্রেও তৎপরতা কমে গেছে। গত জানুয়ারিতে মার্কিন সাহায্য হ্রাসের অংশ হিসেবে ইউএস ফেমিনিয়ার ইয়ারলি ওয়ার্নিং সিস্টেমস নেটওয়ার্কের কার্যক্রম স্থগিত হয়। অথচ কয়েক দশক ধরে এ নেটওয়ার্ক ছিল দুর্ভিক্ষ তথ্য সংগ্রহের অগ্রদূত।গাজায় অবরুদ্ধ ২১ লাখ মানুষের কাছে পর্যাপ্ত খাদ্য পৌঁছানোর ক্ষেত্রে মানবিক সংস্থাগুলোকে নিয়মিত বাধা দিচ্ছে ইসরায়েল। কিন্তু এ পরিস্থিতি সারা বিশ্ব দেখছে নির্বিকারভাবে।
হামাসকে পরাস্তের কৌশল দাবি করে গত মার্চে গাজায় সম্পূর্ণ অবরোধ আরোপ করে ইসরায়েল। সেই সঙ্গে ১০ সপ্তাহের জন্য সব মানবিক সামগ্রী প্রবেশেও বাধা দেয়। তবে আন্তর্জাতিক চাপ ও নিন্দার কারণে ইসরায়েল কিছু খাদ্য প্রবেশে শিথিলতা আনলেও ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম বলেছে, এটি প্রয়োজনের তুলনায় ছোট একটি অংশ মাত্র।
জাতিসংঘ-সমর্থিত খাদ্য নিরাপত্তা মনিটরিং প্যানেল আইপিসি গত শুক্রবার ঘোষণা করেছে, গাজা সিটিকে কেন্দ্র করে চলমান দুর্ভিক্ষ অন্যত্রও ছড়াতে পারে। অঞ্চলটির ৫ লাখ মানুষ এরই মধ্যে ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও মৃত্যুর মুখোমুখি হয়ে জীবন কাটাচ্ছেন।ডি ওয়াল বলেন, ‘ইসরায়েল বিশ্বকে বোঝানোর চেষ্টা করেছে, এটি দুর্ভিক্ষ নয়। কিন্তু তারা গাজাকে দুর্ভিক্ষের মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। এখন এর পরিণতি অনেকগুণ ভয়ঙ্কর হবে।’দুই বছরের বেশি সময় ধরে সুদানে লড়ছে সেনাবাহিনী ও প্যারামিলিটারি র‍্যাপিড সাপোর্ট ফোর্স। এ যুদ্ধে বরাবরের মতোই বিশ্বের আগ্রহ কম। তবে সংখ্যাগতভাবে দেশটির দুর্ভোগ গাজার চেয়ে অনেক বড়। এরই মধ্যে দেশটির দেড় কোটি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে, যা মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক। তারা তীব্র খাদ্য অনিশ্চয়তার রয়েছে বলে জানিয়েছে ডব্লিউএফপি। দুর্ভিক্ষের মুখোমুখি প্রায় ৬ লাখ ৩৮ হাজার মানুষ।জাতিসংঘের হিউম্যানিটারিয়ান অ্যাফেয়ার্সের আন্ডার-সেক্রেটারি টম ফ্লেচার বলেছেন, ‘আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বলেছে, আমরা সুদানের মানুষকে রক্ষা করব। সুদানের মানুষের০ প্রশ্ন করা উচিত, আমরা কখন, কোথায় এবং কীভাবে সেই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন শুরু করব।’
১৮৭৬ সাল থেকে সংঘটিত সব বড় দুর্ভিক্ষের ডাটাবেস তৈরি করেছে তাফটস বিশ্ববিদ্যালয়। সেখানে দেখা যাচ্ছে, ১৯৬০ সালে চূড়ান্ত পর্যায়ে ঠেকেছিল ক্ষুধাজনিত মৃত্যু। চীনের মাও সেতুংয়ের গ্রেট লিপ ফরওয়ার্ডের সময় ১৯৫৮-৬২ সালের মধ্যে প্রায় ৩ কোটি ৬০ লাখ মানুষ মারা গিয়েছিল। এর মূল কারণ ছিল, সেন্সরশিপ এবং কৃষি ও শিল্পায়নে ভুল পরিকল্পনা। এরপর থেকে বিশ্বে নিয়মিত দুর্ভিক্ষ ঘটেছে।১৯৬৮-৭০ সালে নাইজেরিয়ার বিয়াফ্রান যুদ্ধ, ১৯৭৫-৭৯ সালে কম্বোডিয়ায় পল পটের শাসন এবং ১৯৮৩-৮৫ সালে ইথিওপিয়া দুর্ভিক্ষের মুখে পড়ে। তবে ওই শতাব্দীর শেষে দুর্ভিক্ষজনিত মৃত্যুর সংখ্যা প্রায় শূন্যে নেমে এসেছিল। এর কারণ হিসেবে গণতন্ত্রের বিস্তারকে সামনে আনেন বিশেষজ্ঞরা। এ নিয়ে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন লিখেছেন, তথ্যের অবাধ প্রবাহ থাকলে ও নাগরিক সমাজের প্রতি সরকার সাড়া দিলে দুর্ভিক্ষ ঘটতে পারে না।
পরিসংখ্যান অনুসারে, দুর্ভিক্ষের কারণে ১৮৭০ থেকে ১৯৭০ সালের মধ্যে বছরে গড়ে ৯ লাখ ২৮ হাজার মানুষ মারা গিয়েছিল। ১৯৮০ সালের পর এ সংক্রান্ত বার্ষিক মৃত্যুহার ছিল ৭৫ হাজার। এরপর ২০০৮-১০ সালের মধ্যে কোনো দুর্ভিক্ষজনিত মৃত্যু রেকর্ড হয়নি।কিন্তু তাফটস অনুমান করছে, ২০২০ সালের পর থেকে বছরে ২-৩ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে দুর্ভিক্ষে, যার অধকাংশই ছিল ইয়েমেন ও ইথিওপিয়ায় সংঘটিত গৃহযুদ্ধের কারণে।
বিশেষজ্ঞরা দুর্ভিক্ষের পুনরাগমনকে কয়েকটি কারণে ব্যাখ্যা করেছেন। যার মধ্যে অন্যতম গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণের কাছে কম দায়বদ্ধ স্বৈরশাসক নেতাদের উত্থান।

সূত্র: এফটি।

Related Articles

Back to top button