হাবিবুর রহমান: ভারতের পশ্চিমবঙ্গের জেলা হচ্ছে কোচবিহার। ঐতিহাসিক গুরুত্ব সম্পন্ন এই শহর কিন্তু বেশ প্রাচীন এবং বেশ সুন্দর সাজানো গোছানো। কুচবিহার কোচ রাজত্বের অতর্ভুক্ত ছিল এবং সেই সাক্ষ্য বহন করে কোচবিহার রাজবাড়ি। জয়পুরের রাজমাতা গায়েত্রী দেবী ছিলেন এই রাজবংশের কন্যা। প্রকৃতির কোলে অবস্থিত এই শহর কিন্তু বেশ ছিমছাম এবং অনেক সুন্দর। তাই শহরের ইঁদুর দৌড়, আওয়াজ এবং ব্যস্ততা থেকে যদি দু-চার দিনের জন্য ছুটি পেতে চান তাহলে কিন্তু ঘুরে আসতেই পারেন কোচবিহার, পরিবারের সকলের সাথে বা বন্ধুদের সাথে বা নিছক যদি একাই থাকতে চান ক’টা দিন তাহলে কিন্তু বেড়িয়ে আসতেই পারেন। ভারতের উত্তর বঙ্গের জনপ্রিয় টিভি চ্যানেল ডিজিটাল বাংলার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বা সিইও গোবিন্দ সাহার ভালবাসায় আমি ১০ দিন কোচবিহারে ছিলাম। আমি কোচবিহারের অপরূপ, প্রাকৃতিক ও সৌন্দর্য দেখেছি। কোচবিহার হচ্ছে রাজার শহর। এখানকার মানুষও রাজার মতোই। প্রত্যেক মানুষের মধ্যে রইয়েছে ভালবাসা ও বিশ্বাস।
কোচবিহারের ‘কোচ’ শব্দটি এসেছে কোচ রাজবংশ থেকে। আর ‘বিহার’ শব্দটি এসেছে সংস্কৃত শব্দভাণ্ডার বিহার বা পরিভ্রমণ থেকে। সপ্তদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে রচিত শাহজাহাননামা গ্রন্থে কোচবিহার নামটির উল্লেখ পাওয়া যায়। অষ্টাদশ শতাব্দীতে মেজর রেনেলের মানচিত্রে কোচবিহার ‘বিহার’ নামে উল্লিখিত হয়। ১৭৭২ সালে ভুটানের সঙ্গে সংঘর্ষের জেরে কোচবিহার-রাজ ধৈর্যেন্দ্র নারায়ণ ও ওয়ারেন হেস্টিংসের মধ্যে একটি চুক্তি সাক্ষরিত হয়। এই চুক্তির ফলে কোচবিহার ব্রিটিশদের একটি করদ রাজ্যে পরিণত হয়। ১৭৭৩ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে একটি চুক্তির মাধ্যমে রাজ্যটি “কোচ বিহার” নামে পরিচিত হয়।
ব্রিটিশ রাজত্ব থেকে শুরু করে মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণের রাজত্বকাল অবধি পুরনো বহু স্মৃতির সাক্ষী এই কোচবিহার। অতীতের উত্তরবঙ্গের একমাত্র পরিকল্পিত নগর ছিল এই কোচবিহার। সাজানো-গোজানো-পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন। এই কোচবিহার শহরকে আরো সাজানো, গোজানো ও পরিচ্ছন্ন রাখতে এবং ডিজিটাল করার জন্য লড়াই করে যাচ্ছে ডিজিটাল বাংলার টিভির সিইও গোবিন্দ সাহা। তিনি কোচবিহার শহরকে আরো উন্নতি করতে চান। এই শহরে আনতে চান বিদেশী পযটকদের।
কোচবিহার রাজবাড়ি বর্তমানে বাংলার পর্যটন মানচিত্রে অন্যতম কেন্দ্র। রাজপ্রাসাদের টানে কোচবিহারে ছুটে আসেন দেশ-বিদেশের পর্যটকরা। রাজা আমলের ঐতিহ্য এবং স্মৃতিবিজড়িত একটি অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র কোচবিহার রানিবাগান। পার্কের অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মন ছুঁয়ে যেতে বাধ্য। পার্কের পেছনদিকেই রয়েছে কোচবিহার তোর্সা নদীর বাঁধ। এখানে নদীতে পারাপার করার জন্য বাঁশের সেতুর ব্যবস্থা রয়েছে। কোচবিহার শরের সাথেই রয়েছে শালবন। ওই শালবনে গেলে মন হারিয়ে যায় প্রকৃতির মাঝে। এছাড়াও আলিপুরদুয়ার জেলায় রয়েছে চিলাপাতা বনাঞ্চল। এইখানে রয়েছে গভীর বন। এটি ডুয়ার্সের জলদাপাড়া জাতীয় উদ্যানের কাছে অবস্থিত।
১৮৮৭ সালে মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণের রাজত্বকালে রোমের সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকার আদলে তৈরি হয়েছিল কোচবিহার রাজবাড়ি। প্রধানত ইট-বালি-সুড়কি দিয়ে তৈরি প্রাসাদটি। রাতের আলোয় এক মোহময় পরিবেশ তৈরি করে রাজপ্রাসাদটি। একে ঘিরে রয়েছে নানান গ্লপ-গাথা। রাজার আগ্রহে রোমান গথিক শৈলী ফুটিয়ে তোলা হয় সেই বিশাল প্রাসাদে। চার হাজার মিটারেরও বেশি জায়গা জুড়ে অবস্থিত প্রাসাদটির উচ্চতা ১২৪ ফুট। প্রাসাদের ভিতর রয়েছে শয়নকক্ষ, বৈঠকখানা, ডাইনিং হল, বিলিয়ার্ড হল, গ্রন্থাগার ইত্যাদি। তা ছাড়াও, সেখানে দেখতে পাওয়া যায় পুরনো দিনের আসবাবপত্র এবং নানা সামগ্রী। কোচবিহারের রাজবাড়ির ইতিহাস জানতে আজও বহু মানুষ ভিড় করেন। কোচবিহারের রাজা নরনারায়ণের লেখা চিঠিই ছিল প্রথম গদ্যে লেখা নিদর্শন। মহারানি গায়ত্রী দেবীর জন্মস্থানও কোচবিহার। রাজাদের সেই যুগ আর নেই। রাজবাড়ি এখন কোচবিহারের অন্যতম আকর্ষণ। এ ছাড়াও এখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশও মুগ্ধ করার মতো। কোচবিহাকে ঘিরে রয়েছে বিস্তর ইতিহাস।
আর রয়েছে এখানকার বিখ্যাত মদনমোহন মন্দির। মন্দিরের অধিষ্ঠাত্রীরা হলেন, মদনমোহন, তারা মা, কালী মা, মা ভবানী। মন্দির দেখতে খুব সুন্দর। মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ন এই মন্দির তৈরি করেন ১৮৮৫-৮৭ সালে। রাসপূর্ণিমায় এখানে বসে রাসমেলা, রাসয়াত্রা। উত্তরবঙ্গের এটি অন্যতম বড় উৎসব। প্রায় ২০০ বছর ধরে একইভাবে চলছে এই উৎসব। শোনা যায় ভৌতিক উপদ্রবের কারণে ১৮১২ খ্রিস্টাব্দে কোচবিহার রাজ্যের ভেটাগুড়িতে চলে যান মহারাজ হরেন্দ্রনারায়ণ।
১৮১২ সালে রাস পূর্ণিমার দিন ভেটাগুড়ির রাজপ্রাসাদে প্রবেশ করেছিলেন কোচবিহারের রাজা হরেন্দ্রনারায়ণ। আর সেই উপলক্ষে বসেছিল প্রথম রাসের মেলা। পরে কোচবিহারের রাজপ্রাসাদ এলাকায় স্থানান্তরিত হয় এই মেলা। কথিত আছে, ১৯১১ সালে রাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণের সময়কালে অসম থেকে এখানে এসেছিলেন বৈষ্ণব গুরু শঙ্করদেব। উত্তরবঙ্গের প্রায় সব জেলা, এমন কি আসাম থেকেও বহু মানুষ অংশ নেন এই উৎসবে। শহরের মধ্যেই রয়েছে বিশাল সাগরদিঘি। এর বিশালত্বের কারণে এর নাম হয়েছে সাগরদিঘি। শীতে গেলে দেখা পাবেন পরিযায়ী পাখিদের।
ঘুরে ঘুরে দেখে নিন বাণেশ্বর মন্দির। শহর থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে। মন্দিরের অধিপতি শিব। এখানে শিবলিঙ্গের অবস্থান, মন্দিরের গর্ভগৃহে, যা সমতল থেকে ১০ ফুট নীচে। মদন চতুর্দশি ও দোলপূর্ণিমায় ভক্তরা এই মন্দির থেকে শোভাযাত্রা করে মদনমোহন মন্দির পর্যন্ত যান। এই মন্দির ঘিরে অনেক পকুর রয়েছে। পুকুরগুলিতে প্রচুর কচ্ছপ দেখা যায়।
তবে খুব স্বাভাবিকভাবেই প্রায় পাঁচশ বছর ধরে চলতে থাকা কোচবিহার রাজ্য সম্পর্কে এখানকার জনমানসে তৈরি হয়েছে বেশ কিছু পৌরাণিক কাহিনী, উপাখ্যান ও কিংদন্তি। রাজ-আমলে নির্মিত এখানকার রাজবাড়ি, বিভিন্ন সৌধ, মন্দির ও প্রতিষ্ঠান; সামাজিক রীতিনীতি ও সংস্কৃতির ধারা কোচবিহারবাসীর কাছে পরম শ্রদ্ধা ও গর্বের বিষয়। কোচবিহারিগণ এখনও কোচবিহার রাজ্যের ইতিহাসকে বিশেষ মর্যাদার চোখেই দেখেন। স্বাভাবিকভাবেই কোচবিহারের ইতিহাস ও ঐতিহ্য বর্তমান পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের অন্যান্য শহরের থেকে অনেকটাই ভিন্ন। এখানে ইতিহাস ও জনস্মৃতি এবং ভাষার বর্ণালী অনেক বেশি জীবন্ত।
সাধারণভাবে কোচবিহারের আদি রাজনৈতিক ইতিহাস ‘প্রাগজ্যোতিষ-কামরূপের’ সঙ্গে যুক্ত করে আলোচনা করা হয়। পুরাণ-বর্ণিত নরক, ভগদত্ত ও বাণাসুরের প্রসঙ্গও চলে আসে কোচবিহারের ইতিহাসচর্চায়। তবে কোচবিহারের রাজনৈতিক ইতিহাসের প্রামাণ্য যুগের সুচনালগ্ন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে কামরূপের বর্মণ রাজবংশের উত্থানকে। খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতকে সৃষ্ট বর্মণ রাজবংশ, ভাস্করবর্মণের (আ: ৬০০-৬৫০ খ্রিস্টাব্দ) রাজত্বকালে, গৌড়ের রাজা শশাঙ্কের (আ:৬০০-৬৩৬) সঙ্গে সংঘাত ও উত্তর ভারতের রাজা হর্ষবর্ধনের (৫৯০-৬৪৭) সঙ্গে মিত্রতার ফলে সমগ্র ভারতের ইতিহাসে গুরুত্ব অর্জন করেছিল।
বর্মণদের পতনের পর, সপ্তম শতকের দ্বিতীয়ার্ধে শালস্থম্ভ নামে একজন উপজাতি-প্রধান (ম্লেচ্ছ) কামরূপে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ম্লেচ্ছ রাজ্যের (যা নবম শতক পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছিল)। দশম শতকের শেষের দিকে কামরূপে প্রতিষ্ঠিত হয় পাল রাজাদের শাসন। তিস্তা-ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় আদিবাসী গোষ্ঠী-প্রধানদের নেতৃত্বে বেশ কিছু রাজনৈতিক সত্তার জন্ম হয় পালদের পতনের পর। ত্রয়োদশ শতকে কামরূপের রাজনৈতিক কেন্দ্র স্থানান্তরিত হয় ‘কামতা’ (অর্থাৎ কামরূপের পশ্চিম অংশে) অঞ্চলে। এখানে আমরা খুঁজে পাই পৃথু এবং সন্ধ্যার মতো দুই জন স্থানীয় রাজার নাম যারা তাঁদের রাজধানী কামরূপ থেকে কামতাপুরে (বর্তমানে কোচবিহার জেলায় অবস্থিত) স্থানান্তরিত করেছিলেন। এরপর থেকে এই অঞ্চলের শাসককে ‘কামেশ্বর’ বা ‘কামতেশ্বর’ (কামতার প্রভু) হিসাবে বর্ণনা করা শুরু হয়। তবে কামতাপুরে তখন কোন একজন রাজার একছত্র আধিপত্য ছিল না। তৎকালীন ঐতিহাসিক উপাদানগুলিতে কামতাপুরের বেশ কিছু রাজার নাম উল্লিখিত হয়েছে। এদের মধ্যে সিংহধ্বজ (আ: ১৩০০-১৩০৫), দুর্লভ নারায়ণ (আ: ১৩৩০-১৩৫০), অরিমত্ত (১৩৬৫-১৩৮৫), গজাঙ্ক (১৩৮৫-১৪০০), শুক্রাঙ্ক (১৪০০-১৪১৫), এবং মৃগাঙ্ক (১৪১৫-১৪৪০) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তবে তাঁদের রাজ্যের আঞ্চলিক বিস্তৃতি সীমাবদ্ধ ছিল কামতার পশ্চিম অংশের মধ্যেই ।
পঞ্চদশ শতকের গোড়ায় খেনবংশীয় নীলধ্বজ (আ: ১৪৪০-১৪৬০) কামতায় একটি নতুন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তাঁর উত্তরসূরি চক্রধ্বজ (১৪৬০-১৪৮০) কামতা রাজ্যের সীমা করতোয়া নদীর পশ্চিম তীরেও সম্প্রসারণ করেছিলেন। কিন্তু পঞ্চদশ শতকের শেষ লগ্নে বাংলার সুলতান হুসেন শাহ (১৪৯৩-১৫১৯) কামতাপুর দুর্গ আক্রমণ করেন। কামতাপুরের রাজা নীলাম্বর (১৪৮০-১৪৯৮) পরাজিত হলে, হুসেন শাহ কামতাপুর দুর্গ ধ্বংস করেন (১৪৯৮-১৪৯৯)। তবে কামতাপুরে হুসেন শাহের শাসন দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। কামতার স্থানীয় গোষ্ঠিপ্রধানেরা (রূপনারায়ণ, মাল কানওয়ার, লক্ষ্মীনারায়ণ, প্রমুখ) এই অঞ্চল থেকে হুসেন শাহের শাসনকে উৎখাত করেছিলেন। ষোড়শ শতকের প্রথম দিকের এমন একটি পটভূমিতে পশ্চিম আসামের পার্বত্য অঞ্চলের মেচ ও কোচ জনজাতি তাঁদের গোষ্ঠী-প্রধান, হারিয়া মেচের (মন্ডল) নেতৃত্বে একটি উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক সত্তা হিসাবে আবির্ভূত হয়েছিল।
হারিয়া মন্ডলের পুত্র বিশ্বসিংহ ও শিষ্যসিংহ পশ্চিম কামরূপ ও হিমালয়-সংলগ্ন বাংলায় জন্ম দেন কোচ রাজ্যের। মহারাজা নরনারায়ণ (১৫৪০-১৫৮৭) এবং তাঁর মহাসেনাপতি চিলারায়ের নেতৃত্বে এই রাজ্য সমগ্র নিম্ন-আসাম ও হিমালায়-সংলগ্ন বাংলায় সম্প্রসারিত হয়েছিল। কিন্তু কোচ রাজ্য বেশিদিন ঐক্যবদ্ধ থাকতে পারেনি। ১৫৮১ খ্রিস্টাব্দে এই রাজ্যটি রঘুদেব নারায়ণ (চিলারায়ের পুত্র) এবং নরনারায়ণের মধ্যে ভাগ হয়ে গিয়েছিল। দুই শাখার মধ্যে অবিরাম সংঘাত, কোচ-রাজ্যকে মুঘলদের আজ্ঞাবহ শক্তিতে পরিণত করে। তবে প্রাণ নারায়ণের (১৬৩২-১৬৬৫) সিংহাসনে আরোহনের সঙ্গে সঙ্গে কোচরা তাঁদের হারানো অঞ্চল এবং রাজনৈতিক প্রাধান্য ফিরে পায়। মীর জুমলার সেনাপতিত্বে ১৬৬১ খ্রিস্টাব্দে মুঘলরা কোচবিহার আক্রমণ করলেও কোচবিহারের স্বাধীন স্বত্তার বিনাশ ঘটেনি।
প্রাণ নারায়ণের মৃত্যুর (১৬৬৫) পর রাজদরবারের অন্তর্কলহ ও দক্ষিণ দিক থেকে মুঘলদের আক্রমণ কোচবিহারে ভুটানের আধিপত্য বিস্তারের সহায়ক হয়। অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগে কোচবিহারের উপর ভুটানের প্রভাব এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছিল যে ভুটানি সেনাদের বিতাড়নের জন্য কোচবিহার, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির স্মরণাপন্ন হয়। ১৭৭৩ সালে স্বাক্ষরিত হয়। ১৭৭৩ থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত ব্রিটিশ-ভারতীয় সরকারের করদমিত্র হিসেবে কোচবিহার তার অস্তিত্ব বজায় রেখেছিল। ব্রিটিশ-শাসকদের তত্বাবধানে আধুনিক শাসনব্যবস্থার সঙ্গে সঙ্গে কোচবিহারে বিকাশ ঘটেছে পাশ্চাত্য শিক্ষার। পাঁচটি মহকুমায় (কোচবিহার সদর, তুফানগঞ্জ, দিনহাটা, মাথাভাঙ্গা ও মেখলিগঞ্জ) বিভক্ত কোচবিহার রাজ্যের ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা, শাসক-শাসিত সম্পর্ক, রাজনৈতিক চেতনা ও সমাজব্যবস্থা বাংলার অন্যান্য অঞ্চল থেকে অনেকটাই ভিন্ন ছিল। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান (জেঙ্কিন্স স্কুল, সুনীতি একাডেমি, ইন্দিরাদেবী স্কুল, নৃপেন্দ্রনারায়ণ স্কুল, ইত্যাদি), মহারাজা জীতেন্দ্রনারায়ণ হাসপাতাল ও কোচবিহার বিমানবন্দর; নারায়ণী সেনা, চিলারায় ব্যারাক ও বিভিন্ন ধরনের উৎসব ও সাংস্কৃতিক-পরম্পরা কোচবিহারের প্রজাদের রাজভক্তির ধারাকে সচল রেখেছিল। রাজা ও রাজপরিবারের সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন ব্যাক্তির নামাঙ্কিত রাস্তা ও তাঁদের মূর্তি কোচবিহারের ভারত-ভূক্তির পরও রাজ-আমলের স্মৃতিকে সজীব রেখেছে।
ভারতের স্বাধীনতার পর কোচবিহারের রাজনীতি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতিতে বিশাল পরিবর্তন এসেছে। পাল্টে গেছে তাঁর জনবৈচিত্র ও প্রথাগত উৎপাদন-ব্যাবস্থা। সামাজিক ক্ষেত্রেও তৈরি হয়েছে বিভিন্ন ধরণের টেনশন। স্বাভাবিকভাবেই রাজ-আমল ও ভারতভূক্তির-পরবর্তী কোচবিহারের তুলানামূলক আলোচনা মাঝে মঝেই প্রাসঙ্গিকতা অর্জন করে। এই প্রাসঙ্গিকতাই কোচবিহারের ইতিহাসকে কোচবিহারিদের কাছে জীবন্ত করে রেখেছে।
রাজপরিবার ছাড়াও কোচবিহারের কয়েকজন উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব এই জেলার জনস্মৃতির মধ্যে ভীষণভাবে প্রবাহমান। এক্ষেত্রে যাঁদের কথা বারবার উঠে আসে তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন রায়সাহেব পঞ্চানন বর্মা (১৮৬৬-১৯৩৫), উপেন্দ্রনাথ বর্মণ (১৮৯৮-১৯৮৮) ও পল্লীগীতি সম্রাট আব্বাসউদ্দিন আহমদ (১৯০১-১৯৬০)। পঞ্চানন বর্মার নেতৃত্বে ক্ষত্রিয় আন্দোলন, সমাজসংস্কার ও শিক্ষা-আন্দোলন এবং পরবর্তীকালের নির্বাচনী-রাজনীতি উত্তরবঙ্গের রাজবংশীদের একটি শক্তিশালী সম্প্রদায়ে পরিণত করেছে। উত্তরবঙ্গের অন্যান্য জেলার মতো কোচবিহারের মানুষও পঞ্চানন বর্মাকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে চলেছেন। কোচবিহারের বিভিন্ন স্থানে (মাথাভাঙ্গা, কোচবিহার, হরিপুর, ইত্যাদি) স্থাপিত হয়েছে বেশ কয়েকটি মূর্তি । পঞ্চানন বর্মার নামে নামাঙ্কিত হয়েছে কোচবিহারের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, রাস্তা ও সেতু। ফলে রাজপরিবারের চিলারায় ও আরোও অনেকের সঙ্গে পঞ্চানন বর্মা জনপ্রিয় ঐতিহাসিক ব্যাক্তিত্বে পরিণত হয়েছেন। অন্যদিকে ভাওয়াইয়া সঙ্গীতের শিল্পী হিসাবে আব্বাসউদ্দিন আহমদও কোচবিহারের জনস্মৃতির পাশাপাশি বৃহৎ বঙ্গে অমর হয়ে আছেন।
লেখক: হাবিবুর রহমান, ডিজিটাল বাংলা টিভি, বিশেষ প্রতিনিধি, বাংলাদেশ।