topআন্তর্জাতিক

পেন্টাগন ও তেল আবিবের মাথাব্যথা শাহেদ-১৩৬ ড্রোন

টাইমস ২৪ ডটনেট: ড্রোন শক্তির নতুন পরাশক্তি হিসেবে বিশ্বের সামরিক বিশ্লেষকদের নজর কেড়েছে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান। দেশটি দাবি করছে, বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী ড্রোন-ক্ষমতাসম্পন্ন পাঁচটি দেশের মধ্যে তারা একটি।পশ্চিমাদের হাজারো নিষেধাজ্ঞার ভেতর থেকেও সীমিত বাজেটে দেশটি যেভাবে অসামান্য ড্রোনশক্তি গড়ে তুলেছে, তা এখন মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তর পেন্টাগন ও জায়নবাদী ইসরায়েলের ঘুম হারাম করে দিয়েছে।
১৩ জুন ইসরায়েলি হামলায় নিহত ইরানের ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর (আইআরজিসি) প্রধান মেজর জেনারেল হোসেইন সালামি বলেছিলেন, “আমাদের এমন ড্রোন আছে, যেগুলো ৭ হাজার কিলোমিটার পর্যন্ত উড়তে পারে এবং যেকোনো স্থানে অবতরণ করতে সক্ষম। ” ইরানের ড্রোন সক্ষমতা গড়ে উঠেছে একদিকে শাহেদ সিরিজের আত্মঘাতী ড্রোনে, তেমনি মোহাজের, আবাবিল, ইয়াসির, কারার, সায়েক্বেহ, সিমোরগ ও আরাশ-এর মতো কৌশলগত, দূরপাল্লার এবং মাল্টিরোল ড্রোনে। এসব ড্রোন আজ শুধু যুদ্ধক্ষেত্রের ভারসাম্য নয়-আন্তর্জাতিক রাজনীতির গতিপথও বদলে দিচ্ছে।
তবে সবকিছুর মধ্যমণি একটিই: ‘শাহেদ-১৩৬’-এটি স্বল্পমূল্যের, কিন্তু অত্যন্ত প্রাণঘাতী ‘সুইসাইড ড্রোন’, যা এখন ইরানি ড্রোন বিপ্লবের প্রতীক।
মধ্যপ্রাচ্য থেকে ইউরোপ পর্যন্ত-একাধিক ফ্রন্টে যুদ্ধের চালচিত্র বদলে দিয়েছে ইরানের তৈরি শাহেদ সিরিজের ড্রোন। এর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত ড্রোনের নাম ‘শাহেদ-১৩৬’।এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রসহ সাতটি দেশ ইরানের এই ড্রোন অবৈধভাবে কপি করেছে এবং ‘শাহেদ ইন্ডাস্ট্রিজ’ থেকে লাইসেন্স ছাড়াই এর উৎপাদন লাইন স্থাপন করেছে। যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া এই দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে তুরস্ক, চীন, তাইওয়ান, সৌদি আরব, বুলগেরিয়া এবং ইউক্রেন।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী ইরানের তৈরি শাহেদ-১৩৬ ইয়েমেন, ইরাক, সিরিয়া, গাজা, এমনকি ইউক্রেন যুদ্ধেও ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। তেহরানের ঘনিষ্ঠ মিত্র রাশিয়া এটিকে নাম দিয়েছে গেরান-২। মূলত, এটি একটি ‘লোন মিউনিশন’ ড্রোন বা ‘সুইসাইড ড্রোন’। লক্ষ্যবস্তুতে গিয়ে নিজেকে বিস্ফোরণে উড়িয়ে দেয়—যার ধ্বংসক্ষমতা রীতিমতো চমকপ্রদ। ২০২২ সাল থেকেই ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে এই ড্রোনের কার্যকারিতা ও খরচের তুলনায় ভয়াবহ ধ্বংসক্ষমতা নিয়ে বিস্তর আলোচনা হচ্ছে।শাহেদ-১৩৬ ড্রোনের কাঠামো অত্যন্ত সহজ হলেও কার্যকারিতায় বিস্ময়কর। এটি ডেল্টা-আকৃতির পাখা, পেছনে বসানো প্রপেলার এবং সাধারণ দুই-স্ট্রোকের পেট্রোলচালিত ইঞ্জিন ব্যবহার করে। ড্রোনটির ফ্লাইট টাইম প্রায় ছয় ঘণ্টা এবং রেঞ্জ প্রায় দুই হাজার কিলোমিটার পর্যন্ত বলে অনুমান করা হয়। এটি ২০০ কিমি/ঘণ্টা গতিতে উড়তে পারে এবং এতে বিস্ফোরকভর্তি ওয়ারহেড যুক্ত করা হয়, যা নির্দিষ্ট লক্ষ্যে গিয়ে আঘাত হানে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হলো—এই ড্রোনের নির্মাণ ব্যয় মাত্র ৩৫ থেকে ৪০ হাজার ডলার। সামরিক ক্ষেত্রে এত কম খরচে এমন কার্যকর ড্রোন তৈরি করতে পারা—এটিই পশ্চিমা সামরিক শক্তির জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
শাহেদ-১৩৬ ড্রোনকে কেন্দ্র করে সবচেয়ে বেশি সরব ভূমিকা পালন করেছে যুক্তরাষ্ট্র। ড্রোনটি রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধে ব্যবহার করায় একে যুদ্ধাপরাধের সমান বিবেচনা করে ইরানের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে তারা। কিন্তু একই সঙ্গে মার্কিন সামরিক শিল্পপ্রতিষ্ঠান SpektreWorks থেকে এক ড্রোন বাজারে আসে যার নাম FLM-136—শুধু নামেই নয়, আকার, কাঠামো, ইঞ্জিন ও ফ্লাইট টাইম—সব কিছুতেই এটি শাহেদ-১৩৬-এর সঙ্গে হুবহু মিলে যায়।
নতুন মার্কিন ড্রোন FLM-136–এর ডিজাইনও ডেল্টা উইং, পেছনে প্রপেলার ও ২১৫ সিসির পেট্রোলচালিত ইঞ্জিনে পরিচালিত। এটি প্রায় ৬ ঘণ্টা উড়তে সক্ষম এবং প্রশিক্ষণ বা শত্রুপক্ষকে বিভ্রান্ত করার কাজে ব্যবহারের উপযোগী হলেও বাস্তবে এটি কামিকাজে ড্রোন হিসেবেও ব্যবহারের উপযোগী। অনেক সামরিক বিশ্লেষক একে শাহেদ-১৩৬–এর ‘কপি-পেস্ট সংস্করণ’ হিসেবে অভিহিত করছেন।
দুই মাস আগে ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরানের ড্রোন দেখে বলেছিলেন, “আমি এক মার্কিন কোম্পানিকে বলেছিলাম, আমি অনেক ড্রোন চাই। ইরান খুব ভালো ড্রোন তৈরি করে এবং মাত্র ৩৫ থেকে ৪০ হাজার ডলারে একটি ড্রোন বানায়। সেই কোম্পানি দুই সপ্তাহ পর আমার কাছে আসে এবং একটি ড্রোন দেখায় যার দাম ৪১ মিলিয়ন ডলার! আমি তাদের বললাম, আমি এটার কথা বলিনি। আমি এমন ড্রোন চাই যা সর্বোচ্চ ৩৫ থেকে ৪০ হাজার ডলারে পাওয়া যায়। এই ড্রোনগুলো খুব ভালো, দ্রুত, প্রাণঘাতী এবং ভয়ংকর। ”
অবশেষে মার্কিন সামরিক শিল্পপ্রতিষ্ঠান SpektreWorks যে ড্রোনটি বানালো তা হুবহু ইরানের শাহেদ-১৩৬ ড্রোনের অনুকরণে তৈরি। নামটিও ইরানি ড্রোনের মতো! এই ১৩৬ নামটা কি কাকতালীয় নাকি কার্বন কপি? এখন প্রশ্ন উঠছে—ট্রাম্প ড্রোন চাইছিলেন ইরান স্টাইলে,আর কোম্পানি বানিয়ে ফেলল একেবারে ইরানি মডেলকেই! তাহলে কি যুক্তরাষ্ট্র সত্যিই ইরানের কাছ থেকে ড্রোন বানানো শিখছে?
২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্র নতুন করে ইরানের ড্রোন কর্মসূচির বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। মার্কিন অর্থমন্ত্রী স্কট বেসেন্ট এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানান, ইরান তার ড্রোন কর্মসূচিতে ব্যবহৃত উপকরণ তৃতীয় দেশের বিভিন্ন সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান থেকে সংগ্রহ করে থাকে। এসব প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির বিরুদ্ধেও নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, এবারের নিষেধাজ্ঞা ‘সর্বোচ্চ চাপ প্রয়োগের নীতির’ অংশ হিসেবে কার্যকর করা হয়েছে।কিন্তু একই সময়ে যখন যুক্তরাষ্ট্র নিজেই শাহেদ-১৩৬-এর আদলে FLM-136 তৈরি করছে, তখন তাদের নিষেধাজ্ঞা নীতির যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন অনেক বিশ্লেষক। তারা বলছেন, এটা এক ধরনের স্ববিরোধিতা। কারণ একদিকে ইরানের ড্রোনকে আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার জন্য হুমকি বলা হচ্ছে, অন্যদিকে ঠিক সেই ড্রোনকেই নিজেদের জন্য নকল করা হচ্ছে।শাহেদ-১৩৬ এখন শুধু একটি ড্রোন নয়—বরং প্রযুক্তিগত আত্মনির্ভরতার প্রতীক, যুদ্ধক্ষেত্রে প্রতিরোধ কৌশলের নতুন সংজ্ঞা এবং নিষেধাজ্ঞানির্ভর বিশ্ব ব্যবস্থার বিরুদ্ধে একটি নীরব প্রতিবাদ। এটি প্রমাণ করেছে, কম খরচে শক্তিশালী প্রতিরক্ষা গড়া শুধু সম্ভবই নয়—আন্তর্জাতিক রাজনীতির ছকও তা বদলে দিতে পারে।

Related Articles

Back to top button