
টাইমস ২৪ ডটনেট : দলিত নামক একটি সংস্থা, ১৯৯৮ সাল থেকে বাংলাদেশে দলিত ও হরিজন সম্প্রদায়ের অধিকার এবং সুশাসনের জন্য নিবেদিত, ইসলামিক রিলিফ সুইডেনের অর্থায়নে আজ ঢাকার সিরডাপ আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ‘জাতীয় দলিত সম্মেলন ২০২৫’ আয়োজন করে। সম্মেলনের মূল লক্ষ্য ছিল দেশের প্রান্তিক দলিত ও হরিজন সম্প্রদায়ের কণ্ঠস্বর নীতিনির্ধারকদের কাছে পৌঁছে দেওয়া এবং তাদের অধিকার ও অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা।
দলিত সংস্থার নির্বাহী পরিচালক জনাব স্বপন কুমার দাস স্বাগত বক্তৃতায় ব্যক্তিগত অভিমত ছাড়াও দলিত জনগোষ্ঠীর বঞ্চনার বাস্তবতা তুলে ধরেন। তিনি বৈষম্যমূলক আইন বাস্তবায়ন এবং সংসদে দলিত নারীদের জন্য অগ্রাধিকারমূলক আসন নিশ্চিত করার দাবি জানান।
দলিত সংস্থার সম্মানিত স্বেচ্ছাসেবক মনা দাস মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনায় বারোটি দাবি উত্থাপন করেন। তিনি সরকারের কাছে অনুরোধ করেন যে, দলিত সম্প্রদায়ের জীবনযাত্রার বাস্তবতা অনুধাবন করতে উক্ত এলাকার প্রতিনিধি পাঠানো হোক।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে বলেন, আইন ও বিচার বিভাগের উপ-সচিব ড. আবুল হাসনাত তার বক্তব্যে সুশাসন, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেন।
সুশাসন প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা: “আমাদের সব কাজ সবার কল্যাণের জন্য পরিচালিত হয়। দেশে যদি যথাযথভাবে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়, তাহলে একটি কল্যাণমূলক রাষ্ট্র গড়ে তোলা সম্ভব।”
প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রতি অঙ্গীকার: “সামাজিক কল্যাণ মন্ত্রণালয় সমাজের নিপীড়িতদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য নিবেদিত। আমাদের দায়িত্ব হলো সমাজের দুর্বল মানুষদের রক্ষা করা।”
দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে অবস্থান: “বাংলাদেশ গরিব দেশ নয়, বরং এটি অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত একটি দেশ। আমাদের প্রচুর সম্পদ রয়েছে, কিন্তু সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো সেগুলো কীভাবে কাজে লাগানো।
প্যানেল আলোচনায় বক্তব্য
ব্যবস্থাগত বাধা দূরীকরণ: নীতি ও অনুশীলনে দলিত অধিকার শীর্ষক আলোচনায় বক্তারা নিম্নলিখিত বক্তব্য রাখেন:
আইন মন্ত্রণালয়ের, যুগ্ম সচিব আবুল হাসনাত বলেন, আয়ামের এন্টি-ডিসক্রিমিনেশন অ্যাক্ট ২০১৮ এর খসড়া প্রস্তুত রয়েছে এবং সরকার এই জনগোষ্ঠি নিয়ে কাজ করছে। সংবিধানের ২৮(৪) ধারার বাস্তবায়নের মাধ্যমে অধিকার আদায়ের চেষ্টা চলছে এবং সম্মেলনে উত্থাপিত প্রস্তাবনা তিনি মন্ত্রণালয়ে পৌঁছে দেবেন।
সীমা দাও বাংলাদেশ উইমেন্স লিবারেশন কেন্দ্র, প্রেসিডেন্ট সীমা দাও বলেন, হরিজন ও দলিত সম্প্রদায় পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার কাজ করেন এবং তাদেরকে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠি বলি। তিনি সরকারের প্রতি আহ্বান জানান এই বিষয়গুলোর বাস্তব প্রয়োগ দেখা এবং নারী নেতৃত্বে দলিত ও হরিজন সম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দকে এগিয়ে আসতে উৎসাহ প্রদান করার।
সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের, সহযোগী অধ্যাপক ড. দেবাশিষ কুমার কুন্ড: দালিতদের শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রাথমিক স্তর থেকে ঝড়ে পড়া রোধ করতে হবে এবং এই সম্প্রদায়ের সমস্যা নিয়ে আরও গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে বলে জানান।
হরিজন ঐক্য পরিষদের সভাপতি কৃষ্ণ লালা বলেন, আমাদের আইনগুলো কাগজে আছে কিন্তু কার্যক্ষেত্রে প্রয়োগ নেই, তাই এখন চর্চায় আনা জরুরি।
দলিতের নির্বাহী পরিচালক স্বপন কুমার দাস বলেন , দলের যুবকদের সংগঠিত করা একটি চ্যালেঞ্জ, তবে আমরা তাদেরকে একত্রিত হতে, সিবিও (Community-Based Organization) গঠন ও নিবন্ধন করার পরামর্শ দিয়েছি। দালিত সম্প্রদায়ের সুযোগ-সুবিধা পেতে সরকারের নজর দেয়ার আহ্বান জানান।
ইতালি রাষ্ট্রদূত, এইচ.ই. আন্টোনিও আলেসান্দ্রে বলেন, দলিত জনগোষ্ঠি তাদের ভয়েস রেইজ করছে, যা অত্যন্ত ভালো। প্রতিবন্ধকতা, বিশেষ করে প্রান্তিক অঞ্চলে সমস্যার সমাধানে আইন বাস্তবায়ন ও সংস্কৃতি অনুসরণ প্রয়োজন। নতুন প্রজন্ম, বিশেষ করে যুবকদের, দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে এবং বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে কাজ করতে হবে। আইন প্রয়োগ বাস্তবতার সাথে মেলাতে হবে। এই কনভেনশনের মাধ্যমে লিঙ্কেজ তৈরি হয়েছে যা ভবিষ্যতে পদক্ষেপ নেয়া সহজ করবে।”
কমিউনিটি এবং আন্তর্জাতিক অংশগ্রহণ
কমিউনিটির কিছু প্রতিনিধির পাশাপাশি আন্তর্জাতিক অংশগ্রহণকারীদের বক্তব্য ছিল:
পংকজ বাসফোর (হরিজন ঐক্য পরিষদ, সদস্য): “আমাদেরকে বাসা ভাড়া দিতে চায় না, তাই আমরা সরকারি বাসস্থানের ওপর নির্ভর করি। উচ্ছেদের আগে আমাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে।”
নুজহাত জাবিন: “যে এলাকায় আমরা কাজ করি সেখানে দলিতদের অন্যান্য সংগঠনকে একসাথে নিয়ে আসতে চাই এবং সাধারণ বিষয় নিয়ে কাজ করতে চাই। যে আইনগুলো খসড়া আকারে আছে, সেগুলো বাস্তবায়িত হোক।”
আদিব ওয়াকার (ডিএফএ, পরিচালক): “নীতিমালা এবং অনুশীলনের মধ্যে ফাঁক কমানোর জন্য নেটওয়ার্ক ও অ্যালায়েন্স গঠন করা প্রয়োজন, এবং উন্নয়ন সংস্থা ও স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে সমন্বয় নিশ্চিত করতে হবে যাতে কাজগুলো অব্যাহত থাকে।”
মার্টিনা বার্কার (GIZ হেড): “আমরা আইন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে একসাথে কাজ করছি, বিশেষ করে প্রবেশাধিকার ও আইন প্রণয়ন বিষয়ে। GIZ নিবিড়ভাবে কাজ করছে এবং ভবিষ্যতে এই বিষয়গুলো নিয়ে আরও কাজ করা হবে।”
গোর্কি গৌরাব (জার্মান ডক্টরস, কান্ট্রি ডিরেক্টর): “আমি হিজড়া, চা বাগানের জনগোষ্ঠী ও আদিবাসীদের সঙ্গে কাজ করেছি। এ বছর থেকেই দলিত সম্প্রদায়ের সঙ্গে কাজ শুরু করেছি। আমরা ফলন, পুষ্টি ইত্যাদির বিষয়ে কাজ করছি। উন্নয়নের লক্ষ্যে আমরা সবাই মিলে একটি সাধারণ ফান্ড গঠন করতে পারি, যা আরও ফলপ্রসূ হবে।”
চলমান চ্যালেঞ্জ ও সরকারি উদ্যোগ
-শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্য: বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দলিত শিক্ষার্থীরা অস্পৃশ্যতা ও বৈষম্যের শিকার হন।
-স্বাস্থ্যসেবা: সরকারি হাসপাতাল এবং স্বাস্থ্যকেন্দ্রে দলিত রোগীদের প্রতি অনেক সময় বৈষম্যমূলক আচরণ লক্ষ্য করা যায়।
-কর্মসংস্থান: উপলব্ধ সুযোগ সীমিত হওয়ায় দলিতরা সাধারণত নিম্ন বেতনের ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত হন।
-আবাসন: জোরপূর্বক উচ্ছেদ এবং ভূমিহীনতার কারণে নিরাপদ আবাসনের সংকট দেখা দিয়েছে।
-সরকারি উদ্যোগ: সরকার কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছে; তবে অধিকাংশ প্রান্তিক দলিত সম্প্রদায়ের এখনও সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির বাইরে রয়েছে।
-সচেতনতার ঘাটতি: একটি সমীক্ষা অনুযায়ী প্রায় ৩৮% প্রান্তিক জনগোষ্ঠী সরকারি সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি সম্পর্কে জানে না এবং তাই এসব সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত রয়েছে।
আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও সামাজিক আন্দোলন
সম্মেলনটি ইসলামিক রিলিফ সুইডেনের অর্থায়নে আয়োজন হওয়ায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণ এবং সহমর্মিতা স্পষ্ট হয়েছে। সুইডেনের মতো দেশ মানবাধিকার রক্ষা এবং উন্নয়ন সহযোগিতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, যেমন রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু সহায়তাসহ তাদের সহমর্মিতা লক্ষণীয়। বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থা এবং আন্তর্জাতিক অংশীদারও বাংলাদেশে দলিত অধিকার ও অন্তর্ভুক্তি বিষয়ে আগ্রহ প্রদর্শন করেছে। বাংলাদেশে দলিত অধিকার আন্দোলনের একটি দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে ঢাকার শাহবাগে বাংলাদেশ দলিত ও বঞ্চিত জনগোষ্ঠী অধিকার আন্দোলন (বিডিওআরএএম) তাদের বারো দফা দাবিতে সমাবেশ করে। এই দাবিসমূহের মধ্যে ছিল:
-দীর্ঘদিনের দাবি ‘বৈষম্য বিলোপ আইন, ২০২২’ দ্রুত পাস করা।
-দলিত কলোনি উচ্ছেদের আগে পুনর্বাসন নিশ্চিত করা।
-নির্বাচনী আইন সংশোধন করে দলিতদের জন্য সংরক্ষিত আসন নির্ধারণ (পুরুষ ও নারী উভয়ের জন্য)।
-দলিত জনগোষ্ঠীর সঠিক পরিসংখ্যান নির্ধারণ।
-সব পরিচ্ছন্নতাকর্মীর স্থায়ী চাকরি ও নির্ধারিত বেতন কাঠামো নিশ্চিত করা।
-স্বাস্থ্য ঝুঁকি মোকাবেলায় প্রয়োজনীয় সুরক্ষা সরঞ্জাম সরবরাহ করা।
সম্মেলনে উত্থাপিত দাবি ও সুপারিশসমূহ বাস্তবায়িত হলে, বাংলাদেশ একটি সত্যিকারের অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গড়ে তোলার পথে এগিয়ে যাবে যেখানে ধর্ম, বর্ণ বা সামাজিক অবস্থান নির্বিশেষে সকল নাগরিক সমান মর্যাদা ও অধিকার ভোগ করবে। সম্মেলনের শেষে এনজিও প্রতিনিধিদের বক্তব্য এবং দলিত সংস্থার ধন্যবাদ বক্তব্যের মাধ্যমে জাতীয় দলিত সম্মেলন-২০২৫ এর সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়।