
টাইমস ২৪ ডটনেট, ঢাকা: ঢাকার উত্তরা দিয়াবাড়িতে সোমবার দুপুর ১টা ৬ মিনিটে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে একটি যুদ্ধ বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় পাইলট ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মো. তৌকির ইসলামসহ ১৯ জন নিহত হয়েছে। এসময় আহত অবস্থায় ১৬৪ জনকে উদ্ধার করে জাতীয় বার্ন ও ঢামেক বার্নসহ বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের পর সন্তানদের খোঁজে ছুটে বেড়াচ্ছেন অভিভাবক ও স্বজনরা। কেউ ছুটছেন স্কুল ভবনের সামনে, কেউ ছুটছেন এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে। আহত শিক্ষার্থীদের অবস্থান নিশ্চিত না হতে পেরে আতঙ্ক আর কান্নায় ভেঙে পড়েছেন অনেকেই। জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে আহত ৬০ জনের অধিক মানুষকে ভর্তি করা হয়েছে। জরুরি ভিত্তিতে রক্তের জন্য ইনস্টিটিউটের ভেতরে এবং বাইরে মাইকিং করা হচ্ছে। জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে আহাজারি করছেন আহতদের পিতামাতা, স্বজন ও সহপাঠীরা। যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় আজ মঙ্গলবার একদিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করা হয়েছে। মর্মান্তিক এই দুর্ঘটনায় নিহত ও আহতদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এবং দেশের এই শোকাবহ মুহূর্তে সংহতি প্রকাশে আজ মঙ্গলবার শোক পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।
জানা গেছে, সোমবার দুপুর ১টা ৬ মিনিটে রাজধানীর উত্তরার দিয়াবাড়িতে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর এফ-৭ বিজিআই প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় ১৯ জন নিহত নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ১৬৪ জন। যুদ্ধবিমানটি উড্ডয়নের কিছুক্ষণ পরই উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভবনের ওপর বিধ্বস্ত হয়। বিমানটি মাইলস্টোন স্কুলের হায়দার হল নামের একটি ভবনের ক্যানটিনের ছাদে গিয়ে আছড়ে পড়ে। দুর্ঘটনাস্থলে গিয়ে বিধ্বস্ত প্লেনের অংশবিশেষ দেখে বোঝা যাচ্ছে বিমানটি স্কুল ভবনের সামনে পড়ে ছিটকে ভবনের সিঁড়ির সামনে চলে যায়। আর এর দুটি পাখার আঘাতে ধ্বংস হয় শিক্ষার্থীতে পরিপূর্ণ দুটি ক্লাসরুম। আক্রান্ত ওই দুই কক্ষ পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। স্কুলের দারওয়ান জানান, ওই ভবনে প্রাথমিক শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ক্লাস হতো। ঘটনাস্থলে ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মুহাম্মদ জাহেদ কামাল বলেন, ঘটনাস্থলে ফায়ার সার্ভিসের ৯ ইউনিট ও ৬ অ্যাম্বুলেন্স কাজ করেছে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, দুপুর ১টার দিকে ক্লাস শেষে শিক্ষার্থীরা স্কুল ভবনের সামনে ও ক্লাসরুমের ভেতরে অবস্থান করছিল। অনেকেই প্রাইভেট ক্লাস বা কোচিংয়ের জন্য অপেক্ষায় ছিল। ঠিক তখনই বিমানটি আছড়ে পড়ে স্কুলের সাত নম্বর ভবনের দোতলায়, যেখানে পঞ্চম থেকে সপ্তম শ্রেণির ক্লাস হয়। সঙ্গে সঙ্গেই সেখানে আগুন ধরে যায় এবং চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে ধোঁয়া ও আতঙ্ক।
মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক নুরুজ্জামান মৃধা বলেন, যে ভবনে বিমান বিধ্বস্ত হয়েছে সেখানে পঞ্চম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির ক্লাস হয়। দুপুর ১টার দিকে ক্লাস শেষ হয়, অনেক শিক্ষার্থী প্রাইভেট ক্লাসের জন্য অপেক্ষা করছিল। হঠাৎ বিকট শব্দে বিমানটি ভবনের ওপর পড়ে আগুন ধরে যায়। আমরা যত দ্রুত সম্ভব শিক্ষার্থীদের বের করে আনার চেষ্টা করেছি। দুর্ঘটনার পরপরই স্কুল চত্বরে জড়ো হন অভিভাবকরা। সন্তানদের নাম ধরে কান্না করছেন, কেউ কেউ ফোনে হাসপাতালে খোঁজ নিচ্ছেন, কেউ আবার অ্যাম্বুলেন্সের পেছনে দৌড়ে যাচ্ছেন। আয়েশা বেগম বলেন, আমার মেয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। ক্লাস শেষে কোচিংয়ের জন্য অপেক্ষা করছিল। এখন ওর খোঁজ পাচ্ছি না। কোথাও নাম নেই, কেউ কিছু বলতে পারছে না। আমি কোথায় যাবো? সাবিনা ইয়াহা নামে এক শিক্ষার্থীর বাবা আব্দুর রহমান বলেন, স্কুলে আসার সময় মেয়ের সঙ্গে কথা বলেছিলাম, বলেছিল সে ক্লাস শেষ করে কোচিংয়ে যাবে। এখন ওর ফোন বন্ধ, স্কুলে নেই, হাসপাতালে খোঁজ নেই। আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি। রাশেদা খানম নামে এক শিক্ষার্থীর চাচি বলেন, আমার ভাতিজা মারুফ সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে। স্কুলের সামনে ছুটে এলাম। কেউ কিছু জানে না। একবার বলছে বার্ন ইনস্টিটিউটে, আবার বলছে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে। কোথায় যাবো বুঝতে পারছি না।
ঘটনাস্থলে বর্তমানে ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ ও সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী, বিজিবিসহ বিভিন্ন সংস্থার সদস্যরা উদ্ধার তৎপরতা চালাচ্ছেন। পাশাপাশি তাদের সহযোগিতায় বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শত শত শিক্ষার্থী কাজ করছেন।
এদিকে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিমান দুর্ঘটনার খবরে স্বজনদের অনেকেই ঘটনাস্থলে ছুটে গেছেন। তাদের আহাজারিতে সেখানকার পরিবেশ ভারী হয়ে উঠেছে। অনেকে প্রিয় মুখটির সন্ধানে এদিক-ওদিক হন্যে হয়ে ছুটছেন। অনেকে কান্নায় ভেঙে পড়েছেন। বিমান বিধ্বস্তে হতাহতের ঘটনায় জরুরি প্রয়োজনে জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে জরুরি হটলাইন চালু করা হয়েছে। হটলাইন নম্বর; ০১৯৪৯-০৪৩৬৯৭।
তবে আন্তবাহিনী জনসংযোগ পরিদফতর (আইএসপিআর) তথ্য অনুয়ায়ী, কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছে আট জন। জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন আছে ৭০ জন। সেখানে দুই জনের মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়েছে। সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) ১১ জনের মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়েছে। চিকিৎসাধীন আছে আরও ১৪ জন। কুর্মিটোলা জেনারেল হসপিটালে দুই জনের মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়েছে। সেখানে কোনও চিকিৎসাধীন নাই। উত্তরার লুবনা জেনারেল হাসপাতাল অ্যান্ড কার্ডিয়াক সেন্টারে দুই জনের মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়েছে। চিকিৎসাধীন রয়েছে আরও ১১ জন। উত্তরা আধুনিক হাসপাতালে একজনের মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়েছে। চিকিৎসাধীন আছে আরও ৬০ জন। উত্তরা ক্রিসেন্ট হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছে একজন।
জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউট ও ঢামেক বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন ৬০ জনের মধ্যে ৩৬ জনের পরিচয় শনাক্ত করা হয়েছে। তারা হলেন; শামীম ইউসুফ (১৪), মাহিন (১৫), আবিদ (১৭), রফি বড়ুয়া (২১), সায়েম (১২), সায়েম ইউসুফ (১৪), মুনতাহা (১১), নাফি (১০), মেহেরিন (১২), আয়মান (১০), জায়েনা (১৩), ইমন (১৭), রোহান (১৪), আবিদ (০৯), আশরাফ (৩৭), ইউশা (১১), পায়েল (১২), আলবেরা (১০), তাসমিয়া (১৫), মাহিয়া (১৩), অয়ন (১৪), ফয়াজ (১৪), মাসুমা (৩৮), মাহাতা (১৪), শামীম (১৭), জাকির (৫৫), নিলয় (১৪), সামিয়া (১৪), আরিয়ান (১২), তৌফিক (১৩), নূসরাত (১৩), তানভীর আহমেদ (১৩)। তাদের মধ্যে তানভীর আহমেদ মারা গেছেন। ঢাকা মেডিকেলে যাওয়া চারজন হলেন; রাইয়ান (১৪), জুনায়েদ (১১), জারিফ (১২) ও সবুজা বেগম (৪০)। এর মধ্যে জুনায়েদ মারা গেছেন। আহতরা বর্তমানে হাসপাতালগুলোরে জরুরি বিভাগে চিকিৎসাধীন।
এদিকে উত্তরার দিয়াবাড়ির মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমানবাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের পর সন্তানদের খোঁজে ছুটে বেড়াচ্ছেন অভিভাবক ও স্বজনরা। কেউ ছুটছেন স্কুল ভবনের সামনে, কেউ ছুটছেন এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে। আহত শিক্ষার্থীদের অবস্থান নিশ্চিত না হতে পেরে আতঙ্ক আর কান্নায় ভেঙে পড়েছেন অনেকেই।
জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে আহতদের জরুরি ভিত্তিতে রক্তের জন্য ইনস্টিটিউটের ভেতরে এবং বাইরে মাইকিং করা হচ্ছে। দলে দলে শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ রক্ত দিতে আসছেন। তবে পজিটিভ রক্ত পর্যাপ্ত হয়ে গেলেও সংকট রয়েছে নেগেটিভ রক্তের। এ অবস্থায় মেডিক্যালের ভেতরে এবং বাইরে মাইকিং করা হচ্ছে রক্তের জন্য। পাশাপাশি মেডিক্যালের বাইরে ট্রাফিক পুলিশ সদস্য সাঈদও তার হ্যান্ড-মাইক দিয়ে নেগেটিভ রক্তের জন্য মাইকিং করছেন। জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে আহাজারি করছেন আহতদের পিতামাতা, স্বজন ও সহপাঠীরা। ওয়ার্ডগুলোর সামনে বিলাপ করছেন তারা। অভিভাবকরা ছুটে এসে সন্তানকে খুঁজছেন, শুধু পোশাক দেখে শনাক্তের চেষ্টা করছেন। হাসপাতালের করিডোরে অসংখ্য অভিভাবক কান্নায় ভেঙে পড়েছেন। কেউ চিৎকার করছেন, কেউ হতবিহ্বল। কয়েক মিনিট পর পর অ্যাম্বুলেন্স ঢুকছে বার্ন ইনস্টিটিউটে, আর স্বজনদের আহাজারিতে ভারী হয়ে যাচ্ছে চারদিকের পরিবেশ। মাইলস্টোনে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে সামিন। দুর্ঘটনার পর বার্ন ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয় তাকে। তার ভাই কান্নারত অবস্থায় বলেন, সামিনের অবস্থা খুবই খারাপ। আইসিইউতে ভর্তি আছে। ডাক্তার বলেছে ৫০ শতাংশ বাঁচার সম্ভাবনা আছে। এই বলে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। ইনস্টিটিউটের নিচ তলা থেকে ৫ম তলা পর্যন্ত প্রতিটি ওয়ার্ডের সামনে স্বজনরা তাদের সন্তান, ভাই বা বোনদের খুঁজছেন। কেউ খুঁজে পেয়েছেন, কেউ এখনও পাননি। ওয়ার্ডগুলোর সামনে কান্না করছেন অভিভাবকরা। রাজধানীর জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে রোগীর চাপে তিল ধারণের জায়গা নেই। আরও ১০-১৫ জন রোগী সেখানে ভর্তি করার সক্ষমতা আছে বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান। এ সময় রোগীদের নিয়ে হিমশিম খেতে দেখা গেছে জরুরি বিভাগের চিকিৎসকদের। তাদের সহায়তার জন্য আরও বিশেষজ্ঞ এবং টিম সেখানে দেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সায়েদুর রহমান।
রাজধানীর উত্তরায় মাইলস্টোন কলেজ ক্যাম্পাসে বিমান বাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় একদিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করা হয়েছে। মর্মান্তিক এই দুর্ঘটনায় নিহত ও আহতদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এবং দেশের এই শোকাবহ মুহূর্তে সংহতি প্রকাশে আজ মঙ্গলবার শোক পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। সোমবার প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে এ তথ্য জানানো হয়।
এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, মঙ্গলবার দেশের সব সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত থাকবে। পাশাপাশি সব সরকারি, বেসরকারি ভবন ও বিদেশে বাংলাদেশি মিশনেও জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত থাকবে। আহত-নিহতদের জন্য দেশের সব ধর্মীয় উপাসনালয়ে বিশেষ প্রার্থনার আয়োজন করা হবে বলেও উল্লেখ করা হয়।