
দুর্গা বেরা: ভারতবর্ষ একটি স্বাধীন দেশ, আমরা স্বাধীন। বাইরে থেকে দেখা পূর্ণ সুন্দর প্রিয় ভারতবর্ষকে জিজ্ঞেস করলাম- ওগো ভারতবর্ষ আমরা কি সত্যিই স্বাধীন? ভারতবর্ষ চোখ রাঙিয়ে বলল- যাচাই করে দেখো? পরদিন সকাল সকাল স্বাধীনতা খুঁজতে বেরলাম।
প্রথমেই গেলাম ব্যক্তিস্বাধীনতার কাছে, বললাম- তোমার স্বাধীনতা কোথায়?
হেসে বলল- ক্রাইম চলা দেশে তুমি স্বাধীনতা খুঁজতে এসেছো? বলল- এখানে ব্যক্তি তো কোন ছাড়, ব্যক্তির কিডনি, লিভার, হার্ট, রক্ত, যোনি, চোখ এদের কারো স্বাধীন ভাবে বেঁচে থাকার অধিকার নেই। মানবতা শয্যাসায়ী, আত্মসম্মান বাজেয়াপ্ত হয়ে গেছে।
তারপর গেলাম বাকস্বাধীনতার কাছে, বলল- সাজিয়ে রাখা দেশে যখন তখন ইচ্ছে মতো ‘সত্যি কথা’ বলতে পারি না গো। ইচ্ছে মতো ‘প্রতিবাদ’ করতে পারিনা। মনে হয় বাকস্বাধীনতা ‘নকল ভিসা’র মতো, দেখাতে গেলেই আটকে দেবে জেলে।
তারপর গেলাম ভালোবাসার কাছে, বললাম- ওগো ভালোবাসা তুমি কি স্বাধীন?
সে প্রথমেই অট্টহাস্য করল, তারপর হাসতে হাসতে কান্না শুরু করল, বলল- ‘ভালোবাসা বিকায় ছলে’। আর প্রেমের কথা কী বলি- এখন প্রণয়ের বলে প্রেম চলে।
ধর্মের কাছে গেলাম, বললাম- হে ধর্ম কোথায় তোমার স্বাধীনতার বর্ম? বলল নেই, সে কবেই খুলে পড়ে গেছে!
সবাই যে ঈশ্বর-আল্লাহর মধ্যে পার্থক্য খোঁজে, ধর্ম নিয়ে হানাহানি করে, মন্দির ভাঙে, মসজিদ ভাঙে। তবে হ্যাঁ, রাজনীতিতে ধর্মে ধর্মে যাতায়াত হয় আখের গোছাতে। এভাবেই এই দেশ নাকি ‘ধর্ম নিরপেক্ষ’।
তারপর নারী’র কাছে গেলাম। বললাম তুমি বলতো নারী, তোমার স্বাধীনতা কোন খানে? বলল- তুমি কে? কেন জিজ্ঞেস করছো? আমাদের তো কেউ এভাবে জিজ্ঞেস করেনা!
বললাম- আমি “ছদ্মবেশী”।
ওরা অবাক হয়ে বলল- নারী স্বাধীনতা আবার কি! আমরা জানি নারী জন্ম থেকে মৃত্যাবধি পরাধীন।
কুমারী বেলায় পিতার কাছে পরাধীন,
বিবাহের পর স্বামীর কাছে পরাধীন,
বৃদ্ধা হলে সন্তানের কাছে পরাধীন।
এতো গেল ট্রেলার, পিকচার এখনো বাকি আছে, — বন্ধু।
বললাম, তাই! বলো বলো।
পাশ থেকে অন্য একজন নারী ‘ও’র পোশাক টেনে বললেন- চুপ কর হারামজাদী।
ও বলল থামো তো ভয় কিসের? হাত থেকে জামা ছাড়িয়ে নিয়ে কান্না চেপে বলল- “সোনার দেশে শুনবে কে আর নারীর নীরব কথা”-
এখানে ধর্ষকের উল্লাস আছে, ধর্ষিতার আর্তনাদের কোনো মূল্য নেই।
মেয়েরা আজ হামেশাই খুন হয়, হামেশাই জ্বলে, হামেশাই আত্মহত্যা করে। চোখ মুছে বলল- এসব রোজকার সামাজিক জলখাবার।
পতিতারা আজও সমাজচ্যুত, তারা নাকি নষ্টা, কিন্তু যেসব পুরুষ পতিতালয়ে রাত কাটায়, যারা নারীকে নষ্টা বানায় তারা সমাজে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায়।
সমাজে ট্রান্সজেন্ডারদের ঠাঁই হয়না।
হিজরা’রা সমাজের বাইরে।
নারী হয়েও ঋতুস্রাব কালিন দেবীর মন্দিরে প্রবেশ নিষিদ্ধ।
আমাদের পোশাকের স্বাধীনতা নেই, প্রতিবাদের স্বাধীনতা নেই, আমাদের শ্লীলতাহানি হয় যত্রতত্র।
বাপের বাড়িতে, শ্বশুর বাড়িতে যথেষ্ট সম্মান ও স্বাধীনতা নেই, এমনকি ‘নিজের বাড়ি’ বলার অধিকারটুকুও নেই। এক নিঃশ্বাসে আরো অনেক কিছু বলতে যাচ্ছিল মেয়েটি, আমি বললাম- থামো মা, শ্বাস নাও।
টাকা পিছন থেকে এসে বলল- জানো, আমরা স্বাধীন দেশে থাকতে পারিনা, আমরা বিদেশি ব্যাঙ্কে থাকি, আর কালোটাকা বলল- আমরা সুইস ব্যাঙ্কে থাকি। কাটমানি বলল- আমি ডন মাফিয়াদের দখলে থাকি। পকেটে আমার জায়গা নেই, সেখানে এখন রিভলবার থাকে।
গণতন্ত্রের কাছে গেলাম, ও বলল-“ভোটের দিন, মানে ঐ গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করার দিন লাশ পড়ে।
‘অগ্রণীর’ চোখে আসন আগে, ক্ষমতা আগে, জনগণ নয়।
‘মাথা’ টাকার জন্য ছোটে, নামের জন্য ছোটে, বদলে গণতন্ত্রকে খুন করে।
রাজতন্ত্রে যেটা চলে সেটা গণতন্ত্র নয়, খেয়োখেয়ি তন্ত্র।”
সততার কাছে গিয়ে বললাম- তোমার স্বাধীনতা আছে? বলল- জীবনের খাতায় সততা নেই, আমরা অসাধুতার হাতে বন্দি। ‘সততা আজ জরাজীর্ণ শঠতার চরাচরে’।
এমনি করে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা খুঁজতে গিয়ে হঠাৎ খেয়াল হল – সূর্য ডুবতে বসেছে, পায়ে জড়তা এসেছে এগোতে পারছিনা। পায়ের দিকে তাকিয়ে বললাম- তোমার আবার কী হল! জুতো বলল- আমার চলার স্বাধীনতা নেই, আর রাস্তা বলল – আমার দোষ নেই, ভোট আসলে পিচ পড়ে।