topসারাদেশ

দফায় দফায় সংঘর্ষে রণক্ষেত্র গোপালগঞ্জ

টাইমস ২৪ ডটনেট, ঢাকা : জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সমাবেশকে কেন্দ্র করে গতকাল বুধবার সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত দফায় দফায় হামলা ও সংঘর্ষে রণক্ষেত্র পরিণত হয় গোপালগঞ্জ। নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের সাথে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর বুলেট ও টিয়ারশেল নিক্ষেপে ৩ জন নিহত হয়েছেন। এছাড়াও সাংবাদিক, পুলিশ ও পথচারীসহ অর্ধশতাধিক আহত হয়েছেন। আহতদের মধ্যে ১৫ জন গুলিবিদ্ধ গোপালগঞ্জ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ১৪৪ ধারা জারি করে জেলা প্রশাসক। পরে গোপালগঞ্জ শহরে বুধবার রাত ৮টা থেকে আজ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত কারফিউ জারি করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এ ছাড়া চার প্লাটুন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সদস্য মোতায়েন করা হয়। সেনাবাহিনী, বিজিবি ও পুলিশ মিলে পরিস্থিতি সামাল দিতে কাজ করছে। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন গোপালগঞ্জ জেলা প্রশাসক মুহম্মদ কামরুজ্জামান।
জানা গেছে, গোপালগঞ্জে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতারা সমাবেশ শেষে ফিরে যাওয়ার সময় সড়ক অবরোধ করে কেন্দ্রীয় নেতাকর্মীদের গাড়িবহরে হামলা চালায় আওয়ামী লীগ ও নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। গতকাল বুধবার দুপুর ২টা ৪৫ মিনিটের দিকে গোপালগঞ্জ শহরের লঞ্চঘাট এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। এ সময় পুলিশ বাধা দিতে গেলে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ ও ধাওয়া পাল্টা ধাওয় এবং ইটপাটকেল নিক্ষেপ শুরু হয়। পরিস্থিতি সামাল দিতে পুলিশ, বিজিবি ও সেনাবাহিনী রাবার বুলেট ও টিয়ারশেল ছুড়ে। এ সময় নেতাকর্মীদের গাড়িবহর লক্ষ্য করে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। তারা বেশ কয়েকটি গাড়ি ভাঙচুর করে এবং একটি পুলিশের গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। এসময় সংঘর্ষে গোপালগঞ্জ শহরের উদয়ন রোডের বাসিন্দা সন্তোষ সাহার ছেলে দীপ্ত সাহা (২৫), কোটালীপাড়ার রমজান কাজী (১৮) ও টুঙ্গীপাড়ার সোহেল মোল্লা (৪১) নিহত হয়েছেন। গতকাল বুধবার বিকেল পৌনে পাঁচটার দিকে গোপালগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক জীবিতেষ বিশ্বাস বলেন, বিকেলে তিনজনকে মৃত অবস্থায় হাসপাতালে আনা হয়। তাঁরা গুলিবিদ্ধ ছিলেন। হাসপাতালের কর্মকর্তা জীবিতেষ বিশ্বাস আরও বলেন, আরও ৯ জনকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় হাসপাতালে আনা হয়। তাঁদের অস্ত্রোপচার হয়েছে। নিহত দীপ্ত সাহার চাচা হাসপাতালে বলেন, দীপ্ত দুপুরের খাবার খেয়ে তাঁর দোকানে যাচ্ছিলেন। শহরের চৌরঙ্গীতে তাঁর পেটে গুলি লাগে। নিহত রমজান কাজীর বাবা কামরুল কাজী বলেন, আমার ছেলেটাকে মেরে ফেলছে। আমার ছেলে তো কোনো দোষ করেনি। আমি আমার সন্তানকে কোথায় পাব? নিহত সোহেল মোল্লা গোপালগঞ্জ শহরের চৌরঙ্গী এলাকার কেরামত আলী প্লাজায় মোবাইল ব্যবসায়ী ছিলেন। তাঁর পরিচয় নিশ্চিত করেছেন একই মার্কেটের দোকানদার জনি খান। হাতবোমা, সাউন্ড গ্রেনেড ও কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপের বিকট শব্দ আর ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার মধ্যে আতঙ্কে শহরের অধিকাংশ এলাকায় দোকানপাট বন্ধ হয়ে গেছে। মানুষের চলাচলও সীমিত হয়ে পড়েছে। পরে সেনাবাহিনীর সাঁজোয়া যানে করে ‘আটকাপড়া’ জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি নেতারা গোপালগঞ্জ পুলিশ সুপারের কার্যালয় ছেড়েছেন।
গতকাল বুধবার বিকেলে অতিরিক্ত আইজি (ক্রাইম) খন্দকার রফিকুল ইসলাম জানান, এনসিপির নেতা কর্মীরা গোপালগঞ্জ এসপি অফিসে আটকা ছিলেন। পরে সোয়া ৫টার দিকে ‘ক্লিয়ার’ হলে তারা চলে যান। এ সময় তিনি আরও জানান, ৩ জনের মৃত্যুর খবর বিভিন্ন মাধ্যমে পাওয়া যাচ্ছে তবে সেটা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
এদিকে গতকাল সকালে গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার উলপুর এলাকায় পুলিশের গাড়িতে আগুন দেওয়া হয় বলে জানিয়েছেন সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মির মো. সাজেদুর রহমান। তিনি বলেন, জাতীয় নাগরিক পার্টির জুলাই পদযাত্রার অংশ হিসেবে বুধবার গোপালগঞ্জ শহরের পৌর পার্কে পদযাত্রা ও পথসভার কথা ছিলো। সেখানে দলটির কেন্দ্রীয় নেতারা আসবেন। তাদের এ পদযাত্রা বানচালের জন্য নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আতাউর রহমান পিয়ালের সমর্থকেরা সদর উপজেলার উলপুর এলাকায় পুলিশের ওপর হামলা চালিয়েছে। তারা পুলিশের একটি গাড়িতে আগুন দিয়েছে। এ ঘটনায় হতাহতের তথ্য এখনও পাওয়া যায়নি।
প্রত্যক্ষদর্শী কয়েকজন বলেন, সমাবেশ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আওয়ামী লীগের লোকজন লাঠিসোঁটা নিয়ে এনসিপির নেতা-কর্মীদের ঘিরে হামলা চালান। এ সময় পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা সাউন্ড গ্রেনেড ও ফাঁকা গুলি ছুড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেন। এনসিপির নেতা-কর্মীরা অন্যদিক দিয়ে গাড়ি ঘুরিয়ে ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন। হামলার ঘটনার পর এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ করেন, আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা এই হামলা চালিয়েছেন। এ সময় পুলিশ-সেনাবাহিনী নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে। তাদের (এনসিপি) বলা হয়েছিল, সবকিছু ঠিক আছে। কিন্তু তাঁরা সমাবেশস্থলে এসে দেখেন, পরিস্থিতি ঠিক নেই। এর আগে বেলা পৌনে ২টার দিকে সমাবেশ শুরুর আগে ২০০ থেকে ৩০০ লোক লাঠিসোঁটা নিয়ে ‘জয় বাংলা’ শ্লোগান দিয়ে এনসিপির সমাবেশস্থলে যান। সে সময় মঞ্চের আশপাশে থাকা পুলিশ সদস্যরা সেখান থেকে দ্রুত আদালত চত্বরে ঢুকে পড়েন। একই সময়ে মঞ্চে ও মঞ্চের সামনে থাকা এনসিপির নেতা-কর্মীরাও দৌড়ে সরে যান। যাঁরা হামলা চালান, তাঁরা সবাই আওয়ামী লীগের সমর্থক বলে এনসিপির নেতা-কর্মীরা অভিযোগ করেছিলেন। ওই সময় হামলাকারীরা মঞ্চের চেয়ার ভাঙচুর করেন, ব্যানার ছিঁড়ে ফেলেন।
একপর্যায়ে জেলা পুলিশ সুপার মো. মিজানুর রহমান ঘটনাস্থলে যান। এনসিপির নেতা-কর্মী ও পুলিশ এক হয়ে ধাওয়া দিলে হামলাকারীরা পালিয়ে যান। বেলা ২টা ৫ মিনিটে সমাবেশস্থলে পৌঁছান এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম, সদস্যসচিব আখতার হোসেন, মুখ্য সংগঠক (দক্ষিণাঞ্চল) হাসনাত আবদুল্লাহ, মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলমসহ কেন্দ্রীয় নেতারা। সেখানে সমাবেশ করে এনসিপি। সমাবেশ শেষে এনসিপির নেতা-কর্মীদের ঘিরে হামলার ঘটনা ঘটে। এর আগে এনসিপির কর্মসূচি ঘিরে গোপালগঞ্জে পুলিশের গাড়িতে আগুন ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) গাড়িতে হামলার ঘটনা ঘটে। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে গোপালগঞ্জ-টেকেরহাট সড়কের সদর উপজেলার কংশুরে এ ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় গোপালগঞ্জের জেলা প্রশাসক মো. কামরুজ্জামান গোপালগঞ্জ জেলায় ১৪৪ ধারা জারি করেছেন। জেলা প্রশাসনের একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এ তথ্য জানান।
অপরদিকে গোপালগঞ্জ জেলা কারাগারে হামলা ও ভাঙচুর চালিয়েছে আওয়ামী লীগ ও নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। তবে এখন পর্যন্ত কারাগার থেকে কোনো বন্দি পালানোর খবর পাওয়া যায়নি। গতকাল বুধবার বিকেল ৪টার দিকে এ হামলার ঘটনা ঘটে। এতে বেশ কয়েকজন কারারক্ষী আহত হন বলে জানা গেছে। হামলার খবর পেয়ে দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছায় সেনাবাহিনী ও পুলিশ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তৎপরতার সঙ্গে হামলাকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয় এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
এদিকে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সমাবেশকে কেন্দ্র করে ব্যাপক সংঘর্ষ ও হামলা-পাল্টা হামলার ঘটনার পর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে গোপালগঞ্জে কারফিউ জারি করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। গতকাল বুধবার রাত ৮টা থেকে আজ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত এ কারফিউ জারি থাকবে। গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় প্রধান উপদেষ্টার সিনিয়র সহকারী প্রেস সচিব ফয়েজ আহম্মদ এ তথ্য নিশ্চিত করেন। এর আগে বিকেলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে গোপালগঞ্জ সদরে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। উক্ত হামলার ঘটনায় সারাদেশে ব্লকেড কর্মসূচি পালন করছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। হামলায় উদ্বেগ জানিয়ে জড়িতদের শাস্তি দাবি করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। জামায়াত আজ বৃহস্পতিবার বিক্ষোভ কর্মসূচি দিয়েছে।
উল্লেখ্য, জুলাই এর প্রথম দিন থেকে দেশ গড়তে জুলাই পদযাত্রা কর্মসূচি পালন করছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। এর মধ্যে দেশের বেশ কয়েকটি জেলায় এই কর্মসূচি পালন করেছে দলটি। মাসব্যাপী এই কর্মসূচির অংশ হিসেবে গতকাল বুধবার গোপালগঞ্জে পদযাত্রা করে।

 

Related Articles

Back to top button