
টাইমস ২৪ ডটনেট: যুদ্ধের ১১তম দিনে এসে অনেকটাই ব্যাকফুটে চলে গেছে ইরান। গতকাল সোমবার সকাল থেকেই ইরানের গরুত্বপূর্ণ সরকারি নানা স্থাপনায় একের পর এক হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। একইসঙ্গে ইরানের ৬টি বিমানবন্দর এবং ১৫টি বিমানও ধ্বংস করেছে দেশটি। তবে এর জবাবে ইসরায়েলের ওপর একযোগে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালিয়েছে ইরান। বড় ধরনের এই হামলার পরই ইসরায়েলে ব্যাপক বিদ্যুৎ বিভ্রাট দেখা দিয়েছে। এর ফলে ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলের বেশ কিছু শহরে বিদ্যুৎ পরিষেবা ব্যাহত হয়েছে। এদিকে জাতিসংঘের পরমাণু প্রকল্প পর্যবেক্ষণ সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল অ্যাটমিক এনার্জি এজেন্সি (আইএইএ)-এর সঙ্গে সহযোগিতা চুক্তি স্থগিতের সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইরান। দেশটির পার্লামেন্ট মজলিশে ইতোমধ্যে এ সংক্রান্ত একটি বিল তৈরির কাজও শুরু হয়েছে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের হামলার বিষয়ে রুশ প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের সাহায্য চেয়ে চিঠি দিয়েছেন ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি। চিঠিতে পুতিনের কাছে আরও বড় সমর্থন চেয়েছেন তিনি। যদিও খামেনি কেমন সহায়তার কথা জানিয়েছেন সে বিষয়ে বিস্তারিত কিছু জানানো হয়নি ইরানের পক্ষ থেকে।
সোমবার সকালে ইরানের রাজধানী তেহরানে দেশটির ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পসের (আইআরজিসি) সদরদপ্তরে হামলা চালানোর দাবি করেছে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ)। ওই হামলায় আইআরজিসির বহু সৈন্য হতাহত হয়েছে বলেও দাবি করেছে ইসরায়েলি বাহিনী। ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর মুখপাত্র ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এফি ডেফরিন বলেছেন, তেহরানে চলমান ইসরায়েলি হামলায় ইরানের বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর সদরদপ্তরেও আঘাত হানা হয়েছে। হামলার বিষয়ে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাৎজ এক বিবৃতিতে বলেছেন, ইসরায়েলের প্রতিরক্ষাবাহিনী বর্তমানে নজিরবিহীন শক্তির ব্যবহার করে তেহরানের কেন্দ্রস্থলে শাসকগোষ্ঠীর লক্ষ্যবস্তু এবং দমনমূলক প্রতিষ্ঠানে আঘাত হানছে। দেশটির স্বেচ্ছাসেবী সশস্ত্র মিলিশিয়া গোষ্ঠী বাসিজের সদরদপ্তর, এভিন কারাগার, ইসরায়েলকে ধ্বংসের সময়গণনা করা ঘড়ি, বিপ্লবী গার্ডের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সদরদপ্তরসহ আরও কিছু সরকারি প্রতিষ্ঠানকে লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে। তেহরানের রাজনৈতিক বন্দিদের দীর্ঘদিন আটকে রাখার জন্য কুখ্যাত কারাগার হিসেবে পরিচিত এভিন কারাগারে ইসরায়েলি হামলায় প্রাথমিকভাবে কোনও বন্দি হতাহত হননি বলে জানা গেছে। বন্দিদের পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দিতেই ইসরায়েলি বাহিনী এই হামলা চালিয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তেহরানের প্রাণকেন্দ্রে ২০১৭ সালে একটি ঘড়ি স্থাপন করা হয়। ফিলিস্তিন স্কয়ারে স্থাপিত ওই ঘড়িতে ২০৪০ সালের মধ্যে ইসরায়েলের পতন হবে- এমন বার্তা প্রচার এবং ক্ষণগণনা করা হয়। এই ঘড়িটি লক্ষ্য করেও হামলা চালিয়েছে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী। ইরানের বিচার বিভাগের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ইসরায়েলের হামলায় তেহরানের এভিন কারাগারের পরিস্থিতি বর্তমানে নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। সেখানে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি ছড়িয়ে পড়ার ঘটনাকে গুজব বলে উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এদিকে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী আরো জানিয়েছে, তারা ইরানের পশ্চিম, পূর্ব ও মধ্যাঞ্চলে অবস্থিত কমপক্ষে ছয়টি বিমানবন্দরে বিমান হামলা চালিয়েছে। সংবাদমাধ্যম আল জাজিরার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, গতকাল সোমবার ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীর হিব্রু ভাষার এক্স অ্যাকাউন্টে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, দূরনিয়ন্ত্রিত যুদ্ধবিমান ১৫টি ইরানি বিমান ও হেলিকপ্টার ধ্বংস করেছে। বিবৃতিতে আরও বলা হয়, এই হামলায় রানওয়ে, ভূগর্ভস্থ বাংকার, একটি জ্বালানি সরবরাহের উড়োজাহাজ এবং ইরানের এফ-১৪, এফ-৫ এবং এএইচ-১ মডেলের বিমান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী দাবি করেছে, বিমানবাহিনী এই বিমানবন্দরগুলো থেকে উড়ান পরিচালনার সক্ষমতা এবং ইরানি সেনাবাহিনীর বিমান শক্তির কার্যক্রম ব্যাহত
করেছে। তবে এই হামলার বিষয়ে ইরানের পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিক কোনো বিস্তারিত প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। এদিকে এসব হামলার জবাবে ইসরায়েলের ওপর একযোগে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালিয়েছে ইরান। দেশটির ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পস (আইআরজিসি) এই হামলা চালানোর কথা জানিয়েছে। বড় ধরনের এই হামলার পরই ইসরায়েলে ব্যাপক বিদ্যুৎ বিভ্রাট দেখা দিয়েছে। এর জেরে ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলের বেশ কিছু শহরে বিদ্যুৎ পরিষেবা ব্যাহত হয়েছে। এই তথ্য জানিয়ে সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা বলেছে, দক্ষিণ ইসরায়েলে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় বেশ কয়েকটি এলাকা বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। টাইমস অব ইসরায়েল জানিয়েছে, ইসরায়েল ইলেকট্রিক করপোরেশন (আইইসি) নিশ্চিত করেছে যে, একটি ক্ষেপণাস্ত্র ‘কৌশলগত অবকাঠামো স্থাপনার’ কাছে সরাসরি আঘাত লেগেছে। এর ফলে আশপাশের বেশ কয়েকটি শহরে বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যাহত হয়েছে। এক বিবৃতিতে আইইসি জানায়, দ্রুত বিদ্যুৎ সরবরাহ পুনঃস্থাপনের লক্ষ্যে আমাদের টিমগুলো এখনই ঘটনাস্থলের দিকে রওনা হয়েছে। এ সময় অবকাঠামোর মেরামত এবং নিরাপত্তা ঝুঁকি অপসারণের কাজ চলছে, যা নিরাপত্তা বাহিনীর সমন্বয়ে পরিচালিত হচ্ছে। এদিকে, হামলার সময় প্রায় ৩৫ মিনিট ধরে সাইরেন বাজতে থাকে, ফলে নাগরিকদের দীর্ঘ সময় আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান করতে হয়। ইসরায়েলের চ্যানেল ১৩ জানায়, ‘ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরুর পর থেকে এবারই ইসরায়েলিরা সবচেয়ে দীর্ঘ সময় আশ্রয়কেন্দ্রে কাটাল।’ এর আগে ইরানের ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পস (আইআরজিসি) ঘোষণা করে, তারা ইসরায়েলের ওপর একযোগে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালিয়েছে। ইরানি সংবাদমাধ্যম তাসনিম জানায়, এই হামলায় কঠিন ও তরল জ্বালানিচালিত ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহারের পাশাপাশি এমন কৌশল ব্যবহার করা হয়েছে, যা ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ভেদ করতে সক্ষম। তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, ইসরায়েলের পাঁচটি স্থান- সাফাদ, তেল আবিব, আশকেলন, আশদোদ এবং বেইসানে রকেট হামলার ঘটনা ঘটেছে।
এদিকে জাতিসংঘের পরমাণু প্রকল্প পর্যবেক্ষণ সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল অ্যাটমিক এনার্জি এজেন্সি (আইএইএ)-এর সঙ্গে সহযোগিতা চুক্তি স্থগিতের সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইরান। দেশটির পার্লামেন্ট মজলিশে ইতোমধ্যে এ সংক্রান্ত একটি বিল তৈরির কাজও শুরু হয়েছে। মজলিশের সদস্য রুহুল্লাহ মোতেফাকেরজাদেহের বরাত দিয়ে গতকাল সোমবার এক বিবৃতিতে এ তথ্য জানিয়েছে ইরানের রাষ্ট্রায়ত্ত টেলিভিশন চ্যানেল ইরনা। ইরনার প্রতিবেদনে মজলিশের স্পিকার মোহাম্মদ বাকের কালিবাফের বক্তব্যকেও উদ্ধৃত করা হয়েছে। গত রোববার পার্লামেন্ট অধিবেশন চলার সময় আইএইএ-এর সঙ্গে সহযোগিতা চুক্তি বাতিল সংক্রান্ত একটি বিল তৈরির প্রস্তাব দেন এমপিরা। সেই প্রস্তাবে সায় দিয়ে কালিবাফ বলেন, এই আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে যত দিন আমরা পেশাদার আচরণের গ্যারান্টি না পাব, তত দিন সহযোগিতা চুক্তি স্থগিত রাখা উচিত। ১৯৭০ সালে আইইএ’র সঙ্গে এনপিটি চুক্তি করেছিল ইরান। সে সময় অবশ্য বর্তমান ইসলাপন্থি শাসকগোষ্ঠী শাসনক্ষমতায় ছিল না। ইরানের সর্বশেষ রাজা বা শাহ রেজা পাহালভী তখন ইরানের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান ছিলেন। আইএইএ-এর সঙ্গে এএনপিটি চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে ইরান প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে দেশটি কখনও পরমাণু অস্ত্র তৈরি বিষয়ক প্রকল্প গ্রহণ করবে না এবং আইএইএ-কে সহযোগিতা করবে। এর পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের হামলার বিষয়ে রুশ প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের সাহায্য চেয়ে চিঠি দিয়েছেন ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি। ইরানের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এ তথ্য জানিয়েছেন। খামেনির দেওয়া চিঠি নিয়ে রাশিয়ায় পৌঁছেছেন ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচি। ইতিমধ্যেই চিঠিটি রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভের নিকট হস্তান্তর করা হয়েছে। সূত্রের বরাত দিয়ে রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইরান চায় ইসরাইল ও মার্কিন হামলার বিরুদ্ধে আরও কিছু করুক পুতিন। যদিও খামেনি কেমন সহায়তার কথা জানিয়েছেন সে বিষয়ে বিস্তারিত কিছু জানায়নি সূত্রটি।
এদিকে সোমবার বৈঠকে আব্বাস আরাগচিকে পুতিন বলেছেন, ইরানের বিরুদ্ধে আগ্রাসন ভিত্তিহীন। ক্রেমলিনে আরাগচির সঙ্গে আলোচনার শুরুতে পুতিন এ মন্তব্য করেন এবং বলেন, ইরানি জনগণকে সাহায্য করতে রাশিয়া প্রস্তুত রয়েছে। ইরানের ওপর মার্কিন হামলার নিন্দা করায় পুতিনকে ধন্যবাদ জানিয়ে আরাগচি বলেন, রাশিয়া ‘সঠিক ইতিহাসের পক্ষে’ অবস্থান নিয়েছে। এ ঘটনায় ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি ও প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ানও পুতিনকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। এর আগে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্রের হামলাকে ‘আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন’ বলে মন্তব্য করেছে রাশিয়া। রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গত রোববার এক বিবৃতিতে এ মন্তব্য করেছে বলে জানিয়েছে আল-জাজিরা। বিবৃতিতে বলা হয়, একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের ভূখণ্ডে ক্ষেপণাস্ত্র ও বোমা হামলা চালানোর এ দায়িত্বজ্ঞানহীন সিদ্ধান্ত। যে যুক্তিই দেওয়া হোক না কেন- আন্তর্জাতিক আইন, জাতিসংঘ সনদ এবং জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবগুলোর সুস্পষ্ট লঙ্ঘন এ হামলা। বিবৃতিতে আরও বলা হয়, আমরা আগ্রাসন বন্ধের আহ্বান জানাচ্ছি। চলমান পরিস্থিতিকে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক পথে ফিরিয়ে নেওয়ার উপযুক্ত পরিবেশ তৈরিতে প্রচেষ্টা বাড়ানোর ওপর জোর দিচ্ছি।