
টাইমস ২৪ ডটনেট: দিন যত গড়াচ্ছে ততই প্রকট এবং জটিল আকার ধারণ করছে ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ। গত মঙ্গলবার দিবাগত রাতে আগের রাতের মতোই বিরামহীন পাল্টাপাল্টি হামলা করেছে উভয় দেশ। এতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছে ইরান ও ইসরায়েলের অবকাঠামো এবং শহরগুলো। এর মধ্যেই ইসরায়েলের ড্রোন ও এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করার দাবি করেছে ইরান। তবে এর বিপরীতে ইরানের ইমাম হোসেন বিশ্ববিদ্যালয়ে হামলা করার পাশাপাশি ১০টি ড্রোন ভূপাতিত করার দাবি ইসরায়েলের। এদিকে ইরানের পরামাণু স্থাপনায় হামলা করার ব্যাপারে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছে যুক্তরাষ্ট্র। একইসঙ্গে ইরান-ইসরায়েল সংঘাতে যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি জড়িয়ে পড়ুক তা চায় না অধিকাংশ মার্কিনি। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র যেন ইসরায়েলকে সহায়তার কথা বিবেচনাতেও না আনে সেই বিষয়ে সতর্ক করেছে রাশিয়া।
এর আগে ইরানকে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের আহ্বান জানিয়েছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তা সত্ত্বেও, ষষ্ঠ দিনের মতো হামলা পাল্টা হামলা চালিয়েছে ইরান-ইসরায়েল। গতকাল বুধবার ইরান ও ইসরায়েল একে অপরের দিকে নতুন ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে বলে রয়টার্সের প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে। ইসরায়েলি সেনাবাহিনী জানিয়েছে, বুধবার ভোরের প্রথম দুই ঘণ্টায় ইসরায়েলের দিকে দুটি ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করা হয়েছে। তেল আবিবের উপর দিয়ে বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে। এদিকে, তেহরানের বাসিন্দাদের সরে যেতে বলেছিলো ইসরায়েল। যাতে তাদের বিমান বাহিনী ইরানের সামরিক স্থাপনাগুলোতে হামলা চালাতে পারে। ইরানি সংবাদ ওয়েবসাইটগুলো জানিয়েছে, তেহরান এবং রাজধানীর পশ্চিমে কারাজ শহরে বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে। এদিকে, গত মঙ্গলবার সোশ্যাল মিডিয়ায় ট্রাম্প সতর্ক করে দিয়েছিলেন যে, মার্কিন ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে। এরপর তিনি ইরানকে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করতে বলেন।
যদিও তিনি বলেছিলেন আপাতত ইরানের নেতাকে হত্যা করার কোনো ইচ্ছা নেই, তবুও তার মন্তব্য ইরানের প্রতি আরও আক্রমণাত্মক অবস্থানের ইঙ্গিত দেয় কারণ তিনি মার্কিন সম্পৃক্ততা আরও গভীর করবেন কিনা তা বিবেচনা করছেন। ট্রাম্প ট্রুথ সোশ্যালে ইরানের আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির কথা উল্লেখ করে লিখেছেন, আমরা ঠিক জানি তথাকথিত সর্বোচ্চ নেতা কোথায় লুকিয়ে আছেন। আমরা তাকে বের করে (হত্যা) করবো না, অন্তত আপাতত নয়। তবে আমাদের ধৈর্য ক্রমশ ক্ষীণ হচ্ছে। এর তিন মিনিট পর ট্রাম্প পোস্ট করেন, নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ। এরপরই ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধের ষষ্ঠ দিনে এসে যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি যুদ্ধে জড়াতে পারে বলে ধারণা করা হয়। এমনিতেই ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় সামরিক ও কূটনৈতিক সমর্থনকারী দেশ হিসেবে যুদ্ধে পরোক্ষভাবে সক্রিয় রয়েছে মার্কিন প্রশাসন। তবে, একেবারে সরাসরি প্রকাশ্যে যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের জড়িয়ে পড়া নিয়ে আলোচনা জোরদার হয়েছে। ইসরায়েলের স্থানীয় সময় রাত ১টায় নেতানিয়াহুর সঙ্গে ট্রাম্পের ফোনালাপ শেষ হয়। নেতানিয়াহু বলেন, যুদ্ধ শুরুর পর থেকে আমি প্রতিদিনই ট্রাম্পের সঙ্গে কথা বলছি। তার ভাষ্য অনুযায়ী, ইসরায়েল একা নয়, যুক্তরাষ্ট্র এই যুদ্ধে তাদের কৌশলগত সহযোগী হিসেবেই পাশে আছে। হোয়াইট হাউজ জানিয়েছে, জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের সঙ্গে ট্রাম্পের বৈঠক প্রায় দেড় ঘণ্টা স্থায়ী হয়। তবে বৈঠকে সরাসরি হামলার বিষয়ে কোনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল বলছে, হামলা ছিল কেবল আলোচনার ‘একটি বিকল্প মাত্র’। ট্রাম্প এখনও আশা করছেন, চাপের মুখে ইরান শান্তিপূর্ণ উপায়ে পারমাণবিক কর্মসূচি বন্ধ করতে রাজি হবে। অন্যদিকে, ইরান বা যুক্তরাষ্ট্র কেউই বসে নেই। লোহিত সাগর থেকে পারস্য উপসাগর পর্যন্ত অস্থিরতা বাড়ছে। রয়টার্স ও এপির প্রতিবেদন অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে অতিরিক্ত যুদ্ধবিমান, রিফুয়েলিং ট্যাংকার ও দুটি বিমানবাহী রণতরী পাঠাচ্ছে। এর মধ্যে একটি হলো ইউএসএস নিমিটজ। এটির ভিয়েতনামে যাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু তা বাতিল করে মধ্যপ্রাচ্যে মোতায়েন করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপে ৩০টির বেশি রিফুয়েলিং বিমান পাঠিয়েছে এবং মধ্যপ্রাচ্যে অবস্থানরত ৪০ হাজার মার্কিন সেনাকে ‘হাই অ্যালার্টে’ অবস্থায় রাখা হয়েছে। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর জানিয়েছে, ইসরায়েলে নিরাপত্তা পরিস্থিতির অবনতির কারণে জেরুজালেম ও তেল আবিবের মার্কিন কনস্যুলার দফতর বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সপ্তাহব্যাপী বন্ধ থাকার ঘোষণা দিয়ে মার্কিন দূতাবাস বলেছে, মার্কিন নাগরিকদের সরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে এখনও কোনও পরিকল্পনা নেই। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি ধ্বংসে শুধু ইসরায়েলের পক্ষে যথেষ্ট আঘাত ও ক্ষতি করা সম্ভব নয়। বিশেষ করে ফরদো পারমাণবিক স্থাপনায়। কারণ এটি একটি পাহাড়ের নিচে অবস্থিত। সেখানে ইসরায়েলি অস্ত্র কার্যকর নাও হতে পারে। এই পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র তাদের বি-২ স্টিলথ বোমারু বিমান দিয়ে ৩০ হাজার পাউন্ড ওজনের ‘ম্যাসিভ অর্ডন্যান্স পেনেট্রেটর’ দিয়ে আঘাত হানার কথা ভাবছে। একজন ইসরায়েলি সামরিক কর্মকর্তা বলেছেন, ফরদোর জন্য পরিকল্পনা আছে এবং তা বাস্তবায়নের সক্ষমতাও রয়েছে। তবে বিস্তারিত কিছু বলেননি তিনি। এদিকে তেহরান স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি যুদ্ধে জড়ালে তারা মধ্যপ্রাচ্যে থাকা মার্কিন
ঘাঁটিগুলোতে আঘাত হানবে। সূত্রের বরাতে নিউ ইয়র্ক টাইমস বলছে, ইরান এরই মধ্যে তাদের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন করেছে। প্রথম হামলার লক্ষ্য হতে পারে ইরাকে থাকা মার্কিন ঘাঁটিগুলো। পরবর্তীতে বাহরাইন, কাতার ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের মার্কিন ঘাঁটিগুলোতে হামলার আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। এছাড়া পারস্য উপসাগরে বিস্ফোরক মাইন বসিয়ে মার্কিন নৌবহরের চলাচল বাধাগ্রস্ত করতে পারে ইরান। এপি জানিয়েছে, মঙ্গলবার তোলা উপগ্রহচিত্রে দেখা গেছে, বাহরাইনে মার্কিন নৌবাহিনীর ৫ম নৌবহরের ঘাঁটিতে আর কোনও জাহাজ নোঙর করা নেই। বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি সংকটকালে ব্যবহৃত নিরাপত্তা কৌশল। ইরান-সমর্থিত হুথি বিদ্রোহী গোষ্ঠী যুদ্ধে ফের সক্রিয় হতে পারে। মে মাসে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এক প্রকার সমঝোতায় পৌঁছালেও ইসরায়েলে এখনও তারা ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে যাচ্ছে। সিরিয়া ও ইরাকে ইরানপন্থি গোষ্ঠীগুলো মার্কিন ঘাঁটিতে হামলা করতে পারে বলেও আশঙ্কা করা হচ্ছে। জানুয়ারিতে জর্ডানে এক মার্কিন ঘাঁটিতে ড্রোন হামলায় তিন মার্কিন সেনা নিহত হয়েছিল। সেই হামলার পেছনেও একটি ইরানপন্থি গোষ্ঠী ছিল। এদিকে, ইরানের অন্যতম শক্তিশালী মিত্র লেবাননের হিজবুল্লাহ গোষ্ঠী এখনও সক্রিয় হয়নি। ইসরায়েলের সঙ্গে সাম্প্রতিক যুদ্ধেই তাদের অস্ত্রভাণ্ডার ধ্বংস হয়েছে এবং প্রভাব হ্রাস পেয়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
যুক্তরাষ্ট্র যেন ইসরায়েলকে সহায়তার কথা বিবেচনাতেও না আনে: রাশিয়া: যুক্তরাষ্ট্রকে আমরা সতর্ক করছি- ইসরায়েলকে সরাসরি সামরিক সহায়তা প্রদান কিংবা এমন সিদ্ধান্ত যেন বিবেচনাতেও না আনে। তারা (যুক্তরাষ্ট্র) যদি এমনটা করে, তাহলে তা মধ্যপ্রাচ্যে মারাত্মক অস্থিরতা সৃষ্টি হতে পারে। ইরানের পক্ষে এমনই সতর্কবার্তা দিয়েছে রাশিয়া। গতকাল বুধবার রাশিয়ার উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই রিয়াবকভ বার্তা সংস্থা ইন্টারফ্যাক্সকে দেওয়া বিবৃতিতে এই সতর্কবার্তা দেন। তিনি জানান, মস্কো বর্তমানে ইসরায়েল ও ইরানের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ রাখছে এবং সংঘাত প্রশমনে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। রাশিয়ার এই হুঁশিয়ারি এমন এক সময় এলো, যখন ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে টানা ছয় দিনের সংঘাত চলছে। ইসরায়েলি হামলার জবাবে ইরান একাধিক ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে ও তেহরান সতর্ক করেছে, যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি যুদ্ধে জড়ালে মার্কিন ঘাঁটিগুলোও হামলার লক্ষ্য হতে পারে। রাশিয়া বহুদিন ধরেই মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের সমালোচনা করে আসছে ও নিজেকে সংঘাত নিরসনের ‘ভারসাম্য রক্ষাকারী শক্তি’ হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করছে।
ইসরায়েলের ড্রোন ও এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করার দাবি ইরানের: ইরানের রাষ্ট্রীয় টিভি আইআরআইবি জানিয়েছে, ইরানি সামরিক বাহিনী বুধবার সকালে ইসপাহানে একটি ইসরায়েলি হার্মিস ড্রোন গুলি করে ভূপাতিত করেছে। নজরদারির জন্য ব্যবহৃত বিধ্বস্ত মনুষ্যবিহীন ড্রোনের ভিডিও ফুটেজও প্রকাশ করেছে তারা। এদিকে সরকারি সংবাদ সংস্থা আইআরএনএ জানিয়েছে, ইরানি সামরিক বাহিনী রাজধানী তেহরান থেকে ৩৫ কিলোমিটার দক্ষিণপূর্বে ভারামিন শহরের জাভাদাবাদ এলাকায় ইসরায়েলের আরও একটি এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান ধ্বংস করেছে। ভারামিনের গভর্নর হোসেইন আব্বাসির বরাতে আইআরএনএ আরও জানিয়েছে, ইরানি সেনাবাহিনীর বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা অত্যন্ত উন্নত যুদ্ধবিমানটিকে গুলি করে ভূপাতিত করে। ইরানের দাবি, গত শুক্রবার (১৪ জুন) ভোরে ইসরাইল বিনা উসকানিতে ইরানে আকস্মিক আক্রমণ শুরু করার পর থেকে ইরানি সশস্ত্র বাহিনীর গুলি করে ভূপাতিত করা পঞ্চম ইসরাইলি যুদ্ধবিমান এটা। ইসরাইল ইরানে ড্রোন ভূপাতিত হওয়ার কথা স্বীকার করেছে। তবে যুদ্ধবিমান ধ্বংসের কথা স্বীকার করেনি। ইসরাইলের সেনাবাহিনী জানিয়েছে, তাদের একটি দূর নিয়ন্ত্রিত ড্রোন ভূ-পৃষ্ঠ থেকে আকাশে নিক্ষেপযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে ভূপাতিত হয়েছে। গতকাল বুধবার ইসরাইলি সেনাবাহিনী জানিয়েছে, আক্রমণের ষষ্ঠ দিনে রাতভর ইরানের লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালানো হয়েছে। এক বিবৃতিতে জানানো হয়, ৫০টিরও বেশি বিমান হামলা চালিয়ে তেহরানের একটি সেন্ট্রিফিউজ উৎপাদন সুবিধা এবং বেশ কয়েকটি অস্ত্র উৎপাদন কেন্দ্রে আঘাত হানা হয়েছে।