টাইমস ২৪ ডটনেট: ইরানে ইসরায়েলি হামলার ঘটনায় মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে নতুন করে উত্তেজনা ছড়িয়েছে। পাল্টা ইরানও হামলা চালিয়েছে। যদিও এ হামলা-পাল্টা হামলায় ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিতে তেমন কোনো ক্ষতিই হয়নি। ইসরায়েল অভিযানের নাম দিয়েছে অপারেশন রাইজিং লায়ন বা জেগে উঠা সিংহ। অপরদিকে ইরান তাদের অভিযানের নাম দিয়েছে ‘ট্রু প্রমিস ৩’। হামলার পাল্টা প্রতিক্রিয়া মধ্যপ্রাচ্যকে একটি পূর্ণমাত্রার যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা।শুক্রবার (১৩ জুন) ইসরায়েলের লক্ষ্যবস্তু ছিল ইরানের প্রধান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র নাতানজ, দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র কারখানা, শীর্ষ কমান্ডার ও পরমাণু বিজ্ঞানীরা। সংবাদমাধ্যম টাইমস অব ইসরায়েলের প্রতিবেদনে বলা হয় এই হামলায় অন্তত ২০০টি যুদ্ধবিমান অংশ নেয়।
ভোররাত থেকে শুরু হওয়া এ বিমান হামলায় প্রথমে ইরানের সামরিক নেতৃত্ব ও গোয়েন্দা কাঠামোতে আঘাত করার চেষ্টা করে। এরপর ধারাবাহিক হামলায় ইরানের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ কেন্দ্র এবং শেষে দেশটির বৃহত্তম ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র নাতানজেতে হামলা চালায়।এতে, দেশটির অভিজাত বাহিনী ইসলামিক বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর (আইআরজিসি) প্রধান হোসেইন সালামি, সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান মেজর জেনারেল মোহাম্মদ বাঘেরি, জরুরি কমান্ড ইউনিটের প্রধান জেনারেল গোলাম আলি রশিদ নিহত হন।
এ ছাড়া, ইরানের পরমাণু জ্বালানি সংস্থার (এইওআই) সাবেক প্রধান ফিরেদুন আব্বাসি ও তেহরানের ইসলামি আজাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের সভাপতি মোহাম্মদ মেহদি তেরাঞ্চিসহ হামলায় দেশটির ৬ জন পরমাণু বিজ্ঞানী নিহত হন। এই ধরনের নেতৃত্বহীনতা ইরানকে কৌশলগতভাবে দুর্বল করে তুলবে বলে শঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক গবেষণা সংস্থা রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউটের গবেষক বারকু ওজচেলিক বলেন, তেহরানের গভীরে গিয়ে এমন নির্ভুল হামলা ইসরায়েলি গোয়েন্দা শক্তি ও সামরিক সক্ষমতার নিদর্শন। পাশাপাশি ইরানের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার সক্ষমতা স্পষ্ট করেছে। এ হামলাকে কৌশলগত ক্ষতি নয়, বরং ইরানের জন্য এক ভীষণ অপমান বলে মনে করেন তিনি।
ইরানের প্রধান সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র নাতানজে কংক্রিট ও পাথরের সুরক্ষায় মাটির ৮ মিটার গভীরে অবস্থিত। হামলার পর সেখান থেকে ধোঁয়ার কুণ্ডলী উঠে এলেও ভেতরের প্রকৃত অবস্থা নির্ণয় করতে পারেনি আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা (আইএইএ)। তবে, ইসরায়েলের দাবি— তারা সেই ভূগর্ভস্থ স্থাপনায় গুরুতর ক্ষতি করেছে। ইসরায়েল এখনো ইরানের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র ফরদোতে হামলা চালায়নি। এটি প্রায় ৯০ মিটার মাটির নিচে অবস্থিত। কেবল যুক্তরাষ্ট্রের জিবিউ-৫৭/বি ‘বাঙ্কার বাস্টার’ বোমার দিয়েই এটি ধ্বংস করা সম্ভব।
ইরান পাল্টা ১০০টির বেশি ড্রোন ছুড়েছে। ড্রোনগুলো অত্যন্ত ধীরগতির। সবগুলো ড্রোনই মাঝপথে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ইসরায়েল-ইরানের মধ্যবর্তী প্রায় ৭০০ মাইল অতিক্রম করতে তাদের সাত ঘণ্টা পর্যন্ত সময় লাগে ড্রোনগুলোর।তাই, ইসরায়েলে উল্লেখযোগ্য ক্ষয়ক্ষতি ঘটাতে হলে আরও বড় পরিসরে ড্রোন হামলা চালানো প্রয়োজন হতো। এই মুহূর্তে ইসরায়েলের আকাশ নিয়ন্ত্রণে একচেটিয়া আধিপত্য দেখা যাচ্ছে।
ইরানের হাতে এখনো প্রায় তিন হাজার উচ্চ গতিসম্পন্ন দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে। তবে কেরমানশাহ অঞ্চলে অবস্থিত ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটিগুলোর ওপর হামলা হওয়ায় এসব অস্ত্রের কার্যক্ষমতা আছে কি-না, তা এখনো স্পষ্ট নয়। বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করছেন, ইরান পরবর্তী প্রতিক্রিয়া— সাইবার হামলা বা আন্তর্জাতিকভাবে রাজনৈতিক চাপে রূপ নিতে পারে।
বিকল্প প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপ হিসেবে ইরান সাইবার হামলা বা ভিন্ন কোনো হামলার পথ বেছে নিতে পারে, যদিও সেগুলো সফল হলেও রাজনৈতিকভাবে হয়তো সমপর্যায়ের জবাব হিসেবে বিবেচিত হবে না। তবে যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালানো তেহরানের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হবে, কারণ এতে যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার শঙ্কা তৈরি হতে পারে।আঞ্চলিক মিত্র লেবাননের হিজবুল্লাহ জানিয়েছে, তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে ইসরায়েলের ওপর কোনো হামলা শুরু করবে না। অপর দিকে ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীরা হাজার মাইল দূরে থাকায় তাদের ভূমিকা সীমিত।
তবে ইসরায়েল এখনও ইরানের দ্বিতীয় বৃহৎ সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র ফরদোতে হামলা চালায়নি। এটি ৮০-৯০ মিটার গভীরে এবং এটি ধ্বংস করতে যুক্তরাষ্ট্রের ১৪টন ওজনের বাঙ্কার বাস্টার বোমা প্রয়োজন। এ বোমা কেবল মার্কিন বি-২ স্টিলথ বোমার থেকেই ছোঁড়া সম্ভব বলে মনে করা হচ্ছে। আর নাতানজে সফল হামলা মানেই যুদ্ধের সমাপ্তি নয়। ফরদোর মত ‘অপ্রবেশযোগ্য’ লক্ষ্য, ইরানের সম্ভাব্য পাল্টা হামলা এবং আন্তর্জাতিক চাপ—সব মিলিয়ে পরিস্থিতি একটি দীর্ঘ, অনিশ্চিত ও বিস্তৃত যুদ্ধের ইঙ্গিত দিচ্ছে। তাৎক্ষণিক নিষ্পত্তির কোনো আলামতের হদিস নেয় এই যুদ্ধে।
