আশিফুল ইসলাম জিন্নাহ: উপমহাদেশের ইতিহাসে ঢাকার নবাব পরিবারের অবদান এবং ধনরত্নপূর্ণ দরিয়া-ই-নূর সিন্ধুকঃ তাদের বলিষ্ঠ উদ্যেগে বঙ্গভঙ্গের মাধ্যমে পূর্ববাংলা ও আসাম প্রদেশ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা, ব্রিটিশ ভারতের সংখ্যালঘু মুসলমানদের সম্প্রদায়গত স্বার্থ রক্ষার্থে অল ইন্ডিয়া মুসলিমলীগ প্রতিষ্ঠা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন পূর্ববাংলার মুসলমানদের চিন্তার জগত, রাজনৈতিক, আর্থ-সামাজিক, শিক্ষা-সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে ব্যাপক ইতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করে। আবার বঙ্গভঙ্গ রদ ও নতুন যুক্তবাংলা প্রদেশ ব্যবস্থায় মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে ১৯৩৭ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে অধিকাংশ আসনে মুসলমান সদস্যরা বিজয়ী হয় এবং এরফলে যুক্তবাংলা প্রদেশের রাজনীতিতে বাঙালী মুসলমানদের উত্থান ঘটে। যুক্তবাংলা প্রদেশের শাসন ক্ষমতা মুসলমান ও মুসলিমলীগের হাতে চলে আসে। যা ১৯৪৭ সালের ব্রিটিশ ভারত এবং যুক্তবাংলা প্রদেশ বিভাগ পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। ১৯৩৭ সালে ফজলুল হকের কৃষক-প্রজা পার্টি ও মুসলিমলীগের সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন, হক সাহেবের মুসলিমলীগে যোগদান ও মুসলিমলীগের সমর্থনে হকের নেতৃত্বে যুক্তবাংলায় মুসলিমলীগ মন্ত্রীসভা সরকার গঠন, ১৯৪০ সালে লাহোরে অনুষ্ঠিত অল ইন্ডিয়া মুসলিমলীগের কনফারেন্সে ফজলুল হক কর্তৃক উত্থাপিত লাহোর প্রস্তাবের মাধ্যমে ব্রিটিশ ভারতের মুসলিম প্রধান পূর্ব ও পশ্চিম অঞ্চলসমূহকে নিয়ে স্বতন্ত্র ও স্বাধীন একাধিক মুসলিম প্রজাতন্ত্র/আবাসভূমি প্রতিষ্ঠার দাবী, লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে জিন্নাহর পাকিস্তান দাবী, আন্দোলন, ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে পাকিস্তান হাসিলের দাবীতে মুসলিমলীগের নির্বাচনে অংশগ্রহন, বিজয় অর্জন, যুক্তবাংলায় শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে মুসলিমলীগ সরকার গঠন, ১৯৪৭ সালে অখন্ড ব্রিটিশ ভারতের অবিভক্ত বাংলা, অবিভক্ত পাঞ্জাব প্রদেশ দুটিসহ মূল উত্তর-পশ্চিম ভারত বিভাগ করে স্বাধীন খন্ডিত ভারতের দুই প্রান্তের দুই বিচ্ছিন্ন মুসলিম প্রধান ভূখণ্ডকে একত্রিত করে যুক্তপাকিস্তান গঠিত ও হাসিল হয়। ঢাকার নবাব পরিবারের প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব ও মুসলিমলীগ নেতা খাজা খায়রুদ্দীন, খাজা নাজিমুদ্দীন এবং নবাব হাবিবুল্লাহসহ অপরাপর সদস্যরা পাকিস্তান আন্দোলনকে সক্রিয়ভাবে নেতৃত্ব প্রদান ও সমর্থন করেছিল নিজ নিজ অবস্থান থেকে। কিন্তু যুক্তপাকিস্তানের দুই দশকের শাসনামলে এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালে নবাব পরিবারের কিছু সদস্যদের ব্যক্তিগত স্বার্থ ও ক্ষমতামুখী রাজনীতি ঢাকার নবাব পরিবারকে পূর্ববাংলার বাঙলীদের কাছে বিতর্কিত এবং জনবিচ্ছিন্ন করে ফেলে। ১৯৭১ সালে একটি যুক্তপাকিস্তান ভেঙ্গে বর্তমান বাংলাদেশ ও পাকিস্তান নামক দুটি মুসলিম রাষ্ট্র সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর নবাব হাসান আসগারী পাকিস্তান চলে যান। ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশে মুসলিমলীগ আছে। পাকিস্তানের রাজনীতিতে বিভিন্ন খন্ডিত মুসলিমলীগ এখনো যথেষ্ঠ প্রভাবশালী। এই হিসাবে ব্রিটিশ ভারত, যুক্তপাকিস্তান, পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এবং উপমহাদেশের রাষ্ট্রনৈতিক মানচিত্র পরিবর্তনের ক্ষেত্রে নবাব পরিবারের পরোক্ষ অবদান আছে বলা যায়।
দরিয়া-ই-নূর(আলোর সমুদ্র)-এর ইতিহাস শোনাতে গিয়ে খাজা হালিম বলেন, এটি পৃথিবীর বিখ্যাত হীরকগুলোর মধ্যে অন্যতম। ২৬ ক্যারেট ওজনের এই গোলাপী আভা সম্পন্ন রত্ন স্বর্ণের বাজুবন্ধের মধ্যে স্থাপিত। এটির আকৃতি কার্নিশযুক্ত আয়তাকার। মূল ২৬ ক্যারেট ওজনের হীরক খণ্ডের বাইরের চারপাশে সংযুক্ত প্রতিটি ৫ ক্যারেট ওজনের ১০টি ডিম্বাকৃতির হীরক। ফলে দরিয়া-ই-নূরের সর্বমোট ওজন ৭৬ ক্যারেট। এটি প্রথমে মারাঠা রাজাদের পারিবারিক রত্ন ছিল। পরে এটি হায়দ্রাবাদের নিজাম সিরাজ-উল-মূলক ৩০ হাজার রুপির বিনিময়ে ক্রয় করেন। একপর্যায়ে এটি পারস্য সম্রাটের হাতে চলে যায়। সেখানে এর অমূল্য গুরুত্ব অনুধাবন করেই এই মহামূল্যবান হীরক খন্ডের নাম দরিয়া-ই-নূর (আলোর সমুদ্র)নামকরণ করা হয়। এরপর এটি হায়দ্রাবাদের নিজামদের হাত বদল হয়ে পাঞ্জাবের শিখ শাসক রনজিৎ সিংহের হাতে চলে যায়। ১৮৪৯ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী পাঞ্জাব দখল করার পর রনজিৎ সিংহের রাজপরিবারের সকল ধনসম্পদসহ কোহিনূর ও দরিয়া-ই-নূর নামক বিশ্বখ্যাত হীরক খণ্ড দুটি তাদের হস্তগত হয়। সেই সময় দরিয়া-ই-নূরের তৎকালীন বাজার মূল্য নির্ধারণ করা হয় ৬৩ হাজার রুপি। ১৮৫২ সালে ব্রিটিশ সরকার দরিয়া-ই-নূর বিক্রির জন্য নিলামের আয়োজন করে। সেই নিলাম অনুষ্ঠানে ৭৫ হাজার রুপি দিয়ে এই ঐতিহাসিক এবং মহামূল্যবান রত্ন দরিয়া-ই-নূর ক্রয় করেন ঢাকার নবাব খাজা আলিমুল্লাহ। সেই সময় থেকে ১৯০৮ সাল পর্যন্ত ৫৬ বছর এটি ঢাকার নবাব পরিবারের সম্পত্তি ছিল। সরকারের কাছ থেকে প্রাপ্ত বিরাট অংকের ঋণের বিপরীতে ১৯০৮ সালে নবাব সলিমুল্লাহ মহামূল্যবান দরিয়া-ই-নূরসহ ১০৯টি স্বর্ণালঙ্কার ও রত্নালঙ্কার সরকারের কাছে বন্ধক রাখেন। তখন এর মূল্য ধরা হয়েছিল প্রায় ১০ লাখ ১০ হাজার রুপি। এর মধ্যে মহামূল্যবান হীরক পাথর দরিয়া-ই-নূরের মূল্যই ছিল ৫ লাখ রুপি। এছাড়া বাজুবন্ধ, চুন্নি-পান্না, হীরক খচিত ফেজ টুপি, মুকুট ছিল।
এগুলো সরকারী ব্যাংকের যে বিশেষ সিন্ধুকে বন্ধক রাখা হয়েছিল সেই সিন্ধুকের নামও দরিয়া-ই-নূর রাখা হয়। এই সিন্ধুকটি ব্রিটিশ সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন পূর্ববাংলা ও আসাম সরকারের কাছে বন্ধক রাখা হয়। উনিশ শতকে কলকাতা ও সিমলা থেকে হ্যামিল্টন এন্ড কোম্পানীর শিল্পীরা এসে নবাব পরিবারের এই বন্ধক রাখা সম্পদগুলো দেখে দেখে এইগুলোর মধ্যে রাখা নবাব সলিমুল্লাহ এবং তার বেগমের ১৪টি বিখ্যাত আকর্ষনীয় স্বর্ণালঙ্কার এবং রত্নালঙ্কারের ছবি এঁকেছিলেন। এরপর তারা সেই আঁকা ছবিগুলোকে একত্রিত করে একটি এলবাম বানিয়ে প্রকাশ করেছিলেন এবং এতে প্রতিটি ছবির নিচে এগুলোর বিবরণ সুন্দরভাবে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। ব্রিটিশরা ১৯৪৭ সালের অগাষ্ট মাসে এই অঞ্চল ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় পর্যন্ত তা কলকাতার হ্যামিল্টন এন্ড কোম্পানীর তত্ত্বাধানে সংরক্ষিত ছিল। ১৯৪৯ সালে নবাব পরিবারের সদস্য খাজা নসুরুল্লাহর সঙ্গে
এস্টেটের ডেপুটি ম্যানেজার বেলায়েত হোসেন সেখান থেকে দরিয়া-ই-নূর ঢাকায় নিয়ে আসেন এবং ইম্পেরিয়াল ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার ঢাকা শাখায় রাখা হয়। ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের পর তা বন্ধ হয়ে গেলে দরিয়া-ই-নূর রাখা বাক্সটি ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের সদরঘাট শাখায় গচ্ছিত রাখা হয়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ব্যাংকটির নতুন নামকরণ হয় সোনালী ব্যাংক। নবাব পরিবার সরকারের কাছে বন্ধক রাখা তাদের পারিবারিক স্বর্ণালঙ্কার ও রত্নালঙ্কারগুলো আর ছাড়াতে পারেনি। ফলে তা স্থায়ীভাবে রাষ্ট্রায়াত্ত সম্পত্তিতে পরিণত হয়েছে। নবাব পরিবারের বন্ধকী সিন্ধুক দরিয়া-ই-নূর সদরঘাটের সোনালী ব্যাংক শাখায় এবং সোনালী ব্যাংকের কেন্দ্রীয় শাখার ভোল্টে নবাব পরিবারের বন্ধক রাখা সকল মহামূল্যবান ধনরত্ন, অলঙ্কার সামগ্রী সংরক্ষিত আছে। সরকারের উচিত, নবাব সলিমুল্লাহর বন্ধকী সিন্ধুক দরিয়া-ই-নূর সদরঘাটের সোনালী ব্যাংক থেকে জাতীয় জাদুঘরে স্থানান্তর করা এবং সোনালী ব্যাংকের ভোল্টে সংরক্ষিত নবাব পরিবারের বন্ধকী ঐতিহাসিক স্বর্ণালঙ্কার রত্নালঙ্কারসমূহ যাদুঘরে বিশেষভাবে লৌহপাত দ্বারা ঘেরা দেয়াল, অত্যাধুনিক দরজা বিশিষ্ট কঠোর নিরাপত্তা কক্ষ নির্মাণ করে দেশ/বিদেশের সাধারণ দর্শনার্থী/পর্যটকদের দেখার জন্য উন্মুক্ত করে দেয়ার ব্যবস্থা করা। ছবিটি ঐতিহাসিক দিক থেকে বিখ্যাত এবং নবাব পরিবারের মহামূল্যবান হীরক খন্ড দরিয়া-ই-নূর। ভাল লাগলে লাইক, কমেন্ট, শেয়ার করুন। চলবে-(পরবর্তী ৮ম পর্ব পড়ার আমন্ত্রণ রইল)। asifultasin18@gmail.com