আশিফুল ইসলাম জিন্নাহ: খাজা হাবিবুল্লাহ এবং ঢাকার নবাব পরিবারের পতনঃ নবাব সলিমুল্লাহর পুত্র খাজা হাবিবুল্লাহ ছিলেন ঢাকার নবাব পরিবারের ব্রিটিশ ভারত সরকারের দিল্লীর দরবার কর্তৃক ফরমান প্রাপ্ত পঞ্চম এবং সর্বশেষ নবাব। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানী সাম্রাজ্য-অষ্ট্রিয়া ও হাঙ্গেরী সাম্রাজ্য-অটোমান সাম্রাজ্যের নেতৃত্বাধীন অক্ষশক্তি ব্রিটিশ-ফ্রান্স- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন মিত্রশক্তির নিকট পরাজিত হলে ব্রিটিশ-ফ্রেঞ্চ মিত্রশক্তি মিলে মধ্যপ্রাচ্যে অটোমান সাম্রাজ্যের অধীন সকল আরব প্রদেশ, অঞ্চল দখল ও ভাগবাটোয়ারা করে নেয়। এ সময় ইঙ্গ-ফরাসী শক্তি তুর্কী অটোমান খিলাফতকে ধবংস করার এবং অটোমান খলিফার বিরুদ্ধে বিচারের ষড়যন্ত্র শুরু করলে তাদের ষড়যন্ত্রকে রুখতে, তুর্কী খিলাফত, তুর্কী খলিফার মর্যাদা রক্ষার্থে ব্রিটিশ ভারতের সংখ্যালঘু মুসলমানরা সর্বভারতীয় খিলাফত আন্দোলন গড়ে তুলে। এর প্রভাব মুসলিম প্রধান যুক্তবাংলাতেও পড়ে। ১৯২০ সালে নবাব হাবিবুল্লাহর উদ্যেগে ঢাকায় খিলাফত কমিটির প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয় এবং তার নেতৃত্বে ঢাকার মুসলমানরা খিলাফত আন্দোলন করে। উনবিংশ শতকের বিশ দশকের দিকে কলকাতার ইয়ং বেঙ্গল সোসাইটির অনুকরণে ঢাকার কিছু পাশ্চাত্য শিক্ষিত ও প্রগতিশীলতার নামধারী মুসলমান বুদ্ধিজীবী মুক্তবুদ্ধির চর্চা আন্দোলনের নামে ইসলাম ধর্ম ও মুসলিম সংস্কৃতির বিরুদ্ধে সাহিত্যিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক প্রচারণা শুরু করলে ঢাকার ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। এমতাবস্থায় নবাব হাবিবুল্লাহ উক্ত বুদ্ধিজীবীদের আহসান মঞ্জিলে তলব করে তাদের ইসলাম ও মুসলিম বিরোধী অপতৎপরতাকে স্তব্দ করে ইসলামী মূল্যবোধকে সমুন্নত রাখার ব্যবস্থা করেন।
ঢাকার নবাব পরিবারের অধঃপতন শুরু হয় প্রথমত নবাব সলিমুল্লাহর ঋণগ্রস্থ ও দেউলিয়া হবার কাল থেকে। দ্বিতীয়ত তার মৃত্যুর পর থেকে নবাব পরিবারের বিভিন্ন সদস্যদের মধ্যে পারিবারিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ও উচ্চাভিলাষের কারণে। তৃতীয়ত নবাব পরিবারের রাজকীয় আভিজাত্য ধরে রাখার এবং বিশাল প্রাসাদ ভবন পরিচালনা করার জন্য যে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, আর্থিক শক্তি, যোগ্যতা, বিচক্ষণতার প্রয়োজন হয় তার কোনটাই নবাব সলিমুল্লাহ পরবর্তীকালে নবাব পরিবারের কারো মধ্যে ছিল না। এরফলে নবাব পরিবারের প্রভাব-প্রতিপত্তি হ্রাসের সাথে সাথে আহসান মঞ্জিলের জৌলুসও কমতে শুরু করে। ১৯৫১ সালে পাকিস্তান সরকার জমিদারী প্রথা বিলোপ আইন প্রনয়ন করে ঢাকার নওয়াব এস্টেটের বিলুপ্তি ঘোষনা করে। তবে আহসান মঞ্জিল, তার চত্বর ও রায়ত স্বত্ত্বভিত্তিক খাস জমিগুলো এই আইনের আওতার বাইরে ছিল। জমিদার উচ্ছেদ আইনের আওতায় ঢাকার নওয়াব এস্টেট অধিগ্রহন করার কারণে অর্থাভাবে নবাব হাবিবুল্লাহর পক্ষে বিশাল প্রাসাদ রক্ষণাবেক্ষণ করা অসম্ভব হয়ে পড়ে এবং এজন্য সঙ্গে সঙ্গে তিনি আহসান মঞ্জিল ছেড়ে পীরবাগে অবস্থিত নবাবদেরই নিজস্ব গ্রীন হাউস নামক বাসভবনে উঠে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে ব্রিটিশ পদবীধারী ঢাকার নবাবদের বংশানুক্রমিক নবাবী শাসনের অবসান ঘটে। নবাব হাবিবুল্লাহ নবাববাড়ি ছেড়ে চলে যাবার পর থেকে নবাব পরিবারের অপরাপর সদস্যরা নিজেদের মনমতো প্রাসাদের কক্ষগুলো ভাড়া দিতে শুরু করে। এরফলে আহসান মঞ্জিল, এর চত্বরটি বস্তি, ময়লার ভাগারে পরিণত হয় এবং স্থানীয় অবৈধ দখলদারদের দখলে চলে যায়।
আখতারুজ্জামান ইলিয়াস তার এক প্রবন্ধে ঢাকার নবাবদের ঢাকার কাগুজে বাঘ বলে অভিহিত করেছেন এবং ঢাকার ইতিহাসবিদ ও গবেষক মুনতাসির মামুন তার ঢাকার কাগুজে নবাব প্রবন্ধে একই মনোভাব ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তাদের বক্তব্য সর্বাংশে সঠিক নয়। কারণ ঢাকার আহসান মঞ্জিলের নবাবগণ ব্রিটিশ সরকারের অনুমোদনপ্রাপ্ত পদবীধারী, তাদের অনুগত এবং পৃষ্ঠপোষকতাপুষ্ট ভূ-সামন্ত পরিবার হয়েও নিজেদের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক যোগ্যতা, দক্ষতা, দূরদর্শীতা, জনপ্রিয়তার মাধ্যমে ঢাকাসহ পূর্ববাংলা এবং ব্রিটিশ ভারতের রাজনীতির গতিপ্রবাহকে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে প্রভাবিত করেছেন। তার প্রমাণ, আহসান মঞ্জিলের খাজা ও নবাব পরিবার ছিল ঢাকার প্রাচীন বণেদী পরিবার এবং যুক্তবাংলার সবচেয়ে বড় প্রভাবশালী ভূ-সামন্ত পরিবার। তাদের উদ্যেগে পুরান ঢাকার পঞ্চায়েত ব্যবস্থার প্রচলন ঢাকার মুসলমানদের মধ্যে সামাজিক একতা, শক্তি, নিরাপত্তা বলয় গড়ে তুলে। বঙ্গভঙ্গের মাধ্যমে ঢাকাকে রাজধানী করে নতুন আলাদা পূর্ববাংলা ও আসাম প্রদেশ প্রতিষ্ঠা পূর্ববাংলার অবাঙালী- বাঙালী মুসলমান অভিজাত, মধ্যবিত্ত এবং কৃষকদের সম্প্রদায়গত মর্যাদা, স্বার্থ, নিরাপত্তা, অগ্রগতি, উন্নয়ন নিশ্চিত করে। রাজধানী ঢাকার অবকাঠামোগত উন্নয়ন শুরু হয়। ঢাকায় অল ইন্ডিয়া মুসলিমলীগের জন্ম হয়। পূর্ববাংলার মুসলমান ও তফসিল হিন্দুদের মধ্যে প্রাথমিক শিক্ষার প্রসার ঘটে।
এছাড়া ঢাকায় আহসানুল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুল (বর্তমান বুয়েট) প্রতিষ্ঠা, ইসলামীয়া এতিমখানা (বর্তমানে সলিমুল্লাহ) প্রতিষ্ঠা, বঙ্গভঙ্গ রদ ও নতুন যুক্তবাংলা গঠনের পর নবাব সলিমুল্লাহর নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব উত্থাপন, তার মৃত্যুর পর নবাব হাবিবুল্লাহ কর্তৃক খিলাফত আন্দোলন পরিচালনা, নবাব পরিবারের অব্যাহত প্রচেষ্টায় ঢাঃবিঃ প্রতিষ্ঠা, ঢাঃবিঃ-এর জন্য রমনা এলাকার শতাধিক একর জমি প্রদান, নবাব পরিবারের অর্থায়নে সলিমুল্লাহ মুসলিম হল নির্মাণ, সলিমুল্লাহর কণ্যার উদ্যেগে কামরুননেসা গার্লস হাইস্কুল প্রতিষ্ঠা ঢাকা এবং পূর্ববাংলার মুসলমানদের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা সৃষ্টি, এবং উচ্চশিক্ষার প্রসার ঘটাতে অগ্রনী ভূমিকা পালন করে। মধুর ক্যান্টিনও একদা নওয়াব এস্টেটের শাহবাগ বাগান বাড়ির নাচঘর ছিল। মুসলিমলীগ কর্তৃক ফজলুল হকের লাহোর প্রস্তাব অনুমোদন, পাকিস্তান আন্দোলন, যুক্তপাকিস্তান প্রতিষ্ঠা, হাসিল, খন্ডিত বর্তমান ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশের রাজনীতিতে মুসলিমলীগের অস্তিত্ত্ব এবং ভূমিকাকে ঢাকার নবাব পরিবারের পরোক্ষ অবদান বলা যায়। আর এজন্য আহসান মঞ্জিলের নবাবদের এবং নবাব পরিবারকে তাদের বিরোধী ও সমালোচকরা সাম্প্রদায়িকতার পৃষ্ঠপোষক বলে অপপ্রচার ও সমালোচনা করেছেন/করে থাকেন। ছবিটি নবাব খাজা হাবিবুল্লাহর। ভাল লাগলে লাইক, কমেন্ট, শেয়ার করুন। চলবে-(পরবর্তী ৯ম পর্ব পড়ার আমন্ত্রণ রইল)।asifultasin18@gmail.com